শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রাজ্যে কাজ নেই,ধানক্ষেতে পড়ে পাকা ধান,পুরুষ মহিলা চাষিরা মোটা টাকার লোভে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে

News Sundarban.com :
নভেম্বর ২৬, ২০২৩
news-image

নিজস্ব প্রতিনিধি, সুন্দরবন : গ্রামের ধান ক্ষেতে পড়ে রয়েছে পাকা ধান। কিন্তু সেই ধান কাটবে কে? উঠেছে সেই প্রশ্ন। কারণ বাংলার চাষীরা এখন পাড়ি দিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ,গুজরাট,তামিলনাড়ুতে। আর তাই গ্রামের মাঠে পড়ে রয়েছে পাকা ধান।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকার বাসন্তী, ক্যানিং, জীবনতলা, গোসাবা, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, কুলতলী ও জয়নগর সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ প্রতি বছর কাজের জন্য চলে যান গুজরাট,অন্ধ্রপ্রদেশ,তামিলনাড়ু, ব্যাঙ্গালোর, কেরালা সহ বিভিন্ন জায়গাতে। কিন্তুঅন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে বাংলার চাষীদের কদর অত্যধিক হারে বেশি। আর তাই গ্রামে পড়ে না থেকে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্য। মূলত ধান চাষের জন্যই এখন তারা রওনা দিচ্ছেন অন্ধ্রপ্রদেশ,গুজরাট, তামিলনাড়ুতে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকাল ট্রেনে করে লোকজন চলেছেন শিয়ালদহ,হাওড়া কিংবা সাঁতরাগাছি স্টেশন হয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে।। তারপর সেখান থেকে সোজা ভিন রাজ্যে। এলাকায় ধানের জমিতে পাকা ধান পড়ে থাকতে কেন তারা ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন?এমন প্রশ্নের উত্তরে গোসাবার কামাক্ষ্যাপুরের ষাটোর্ধ মহিলা চাষী কানন বালা মুন্ডা বলেন, ওখানে দেড় মাস কাজ করলে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বাড়িতে আনা যাবে। কিন্তু এলাকায় দেড় মাস কাজ করলে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকার বেশি ঘরে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে ওখানে থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা জমির মালিকরাই করে দেন। এখানে বাড়ির খেয়ে সব কাজ করতে হবে।তারপর এখানে ঠিকমতো কাজ নেই।সংসার চালাবো কি ভাবে? এখানে আয় থাকলে কেউ বৃদ্ধা বয়সে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যায়?’

বিগত দিনে করমন্ডল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে কতটা আতঙ্কিত?সে সম্পর্কে কানন দেবী জানিয়েছেন,আমরা আদিবাসী।সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা পাই না। পেটের জ্বালায় ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়। যদি ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সে অনেক ভালো!সরকার কে বলবো ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেলে মৃতদেহ টা ফেলে দিতে!’

শুধু পুরুষরা নয় চাষের কাজের জন্য অসংখ্য মহিলারাও বাড়ি থেকে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্য। পুরুষদের সাথে তারাও যাবেন মাঠে কাজ করতে। প্রায় ৩০-৩৫ জনের দলে ভাগ হয়ে সকলেই পৌঁছাচ্ছেন ভিন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকাতে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই তাদের সঙ্গে তামিলনাড়ু,অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালার বিভিন্ন মালিকদের কথা হয়ে যায়। কতটা জমি তাদের রোয়ার(ধানের বীজবোনা)কাজ করতে হবে । আর তার জন্য কতদিন সময় লাগবে। সব কথা ঠিকঠাক হলেই তবেই তারা বাড়ি থেকে রওনা দেন কাজের উদ্দেশ্যে। তবে একবার কোনো মালিকের কাছে কাজ পাকা হলে সেখানেই প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যান এইসব চাষিরা।

এ বিষয়ে ভিন রাজ্যের চাষের কাজে যাওয়া একচাষী সন্ন্যাসী সর্দার বলেন, ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছি।আমরা আদীবাসী। কোন রকম চাকরি কিংবা সরকারী সুযোগ সুবিধা পাইনি।পেটের জ্বালায় দীনমজুরের কাজ করতে হয়।গ্রামে কোন কাজ নেই। সংসার কিভাবে চালাবো?তাই জীবনের ঝুঁকি থাকলেও ভিনরাজ্যে যেতে হয়। সরকার আমাদের সুযোগ সুবিধা দিলে ভিন রাজ্যে যেতে হবে না। কিন্তু কোথায় সেই সুযোগ?’

অন্যদিকে অপর এক মহিলা চাষী অন্তা সর্দার জানিয়েছেন,‘সুন্দরবনে গ্রামের এলাকায় মহিলাদের ২০০-২৫০ টাকার বেশি রোজ দিতেই চায় না জমির মালিকরা। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ কিংবা তামিলনাড়ুতে গিয়ে ধান রোয়ার কাজ করলে পুরুষদের সমতুল্য প্রায় হাজার টাকা বারশো টাকা রোজ হয়। ফলে তাই যেতেই হয়। তাছাড়া এলাকায় কোন কাজ নেই। কয়েকদিনের ধান কাটা শেষ হলেই আর কোন কাজ পাওয়া যাবে না।’

উল্লেখ্য, সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার জমি এক ফসলি। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ধান রোয়ার পর তা অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসের মধ্যে কাটা সম্পন্ন হয়ে যায়।সেই ধান এখন পাকতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও কাটাও শুরু হয়ে গিয়েছে। আর তাই সেই ধান কাটার জন্য এখন এলাকার চাষী পাওয়া দুষ্কর। আর তাই ধান কেটে ঝাড়ায় মাড়াই করে ঘরের তোলা লোকের অভাব দেখা দিয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপে । এমনিতেই জীবন জীবিকার জন্য বহু পুরুষ আগে থেকেই কেরালা বা তামিলনাড়ুতে থাকেন। এবার ধান রোয়ার জন্য তাই চাহিদা বেড়েছে সুন্দরবন এলাকার মহিলাদেরও। সবমিলিয়ে সুন্দরবনের কর্মহীন পুরুষ মহিলারা এখন জীবন জীবিকার তাগিদে ভিন রাজ্যের দিকে তাকিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন।