সুন্দরবনে নিমাই মালী পাচ্ছেন শিক্ষারত্ন
বিশ্লেষণ মজুমদার,ক্যানিং -অভাব অনটনের জেরে স্কুলছুট হয়ে যাওয়াটাই ছিল দস্তুর। সেই সমস্ত ছেলে মেয়েদের কে স্কুলে ফেরানোর ব্রত নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ২৩ বছর ধরে নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে সুন্দরবনের ভূমিপুত্র তপশিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের নিমাই মালী। সুন্দরবনে বিশেষ করে তপশিলি জাতি ও উপজাতির ছেলে মেয়েদের কে স্কুলমুখি করে তোলাই চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করে লেখাপড়ার আঙিনায় নিয়ে এসে শিক্ষিত করে তোলার কাজ শুরু করেন। সেই কাজের স্বীকৃতি হিসাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একমাত্র শিক্ষক তথা প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের চুনাখালি হাটখোলা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিমাই মালী কে এবছর রাজ্য সরকার শিক্ষারত্ন এ ভূষিত করছে।
বাসন্তী ব্লকের চুনাখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের চুনাখালি আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দা নিমাই।বাবা ভূবন মালী ও মা সূধা দেবীর পক্ষে সন্তানদের লেখাপড়া করানো ছিল রীতিমতো কষ্টের।নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় তাদের আবার লেখাপড়া। চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় নিমাইয়ের মনে জেদ চেপে বসে পড়াশোনা করে বড় হয়ে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষজনদের কে সমাজের উচ্চতরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে তপশিলি উপজাতি সমাজকে।সেই জেদ নিয়ে নিজেই পড়াশোনার খরচ জোগাড় করার জন্য দিনমজুর থেকে পাড়ার আভিজাত্য ব্যক্তিদের ফাইফরমাস কাজ করে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। প্রথমে চুনাখালি আদিবাসী পাড়ার এফ পি স্কুলে ভর্তি হন। সেখানের পাঠ শেষ করে শম্ভুনগর হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের হাজী দেশারত কলেজে পড়াশোনা করেন। পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে আর উচ্চশিক্ষা হয়ে ওঠেনি।
১৯৯৯ সালের ১২ নভেম্বর চাকরি পেয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন চুনাখালি হাটখোলা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্তও এলাকার দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে টিউশন পড়িয়েছেন।শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে শিশু ও কিশোর উপযোগী লেখা এবং বিভিন্ন দৈনিক সংবাদ পত্রে শিক্ষা ও সমাজকল্যান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন নিমাই বাবু।
এছাড়াও এলাকার তপশিলি সহ অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের অগ্রগতির জন্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে বিবেকানন্দ ফুটবল একাডেমী গঠন,প্রতিমাসে ছাত্রছাত্রীদের জন্মদিবস পালন, পিঠে-পুলি উৎসব,পরিবেশ দূষন ও জলসংরক্ষনের উপর পথনাটক মঞ্চস্থ, ঈদ ও দুর্গোৎসবে প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের নতুন পোষাক ও পরিবারদের আর্থিকসাহায্য প্রদানের কাজ অনবরত করে চলেছেন। বিগত চার বছর পুষ্টিকরন কর্মসুচী, প্রতিমাসে ৩০০ জন ছাত্রছাত্রী ও প্রসূতি মায়েদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সহ প্রয়োজনীয় ঔষধের ব্যবস্থা করা। আম্ফান ইয়াসে দুহাজার পরিবারের হাতে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা ,কমিউনিটিকিচেন পরিচালনার মতো জনহিতকর কাজ করেছেন।
শিক্ষকতা করার পাশাপাশি সামাজিক ক্রিয়াকলাপের জন্য স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১৩ সালে বিরসা মুন্ডা স্মৃতি রক্ষা কমিটি কর্তৃক সেরা শিক্ষক সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন।২০১৬ সালে ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিখুঁত বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ দ্বারা রাজ্যের সেরা বিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
এহেন ব্যক্তিত্ব কে রাজ্য সরকার শিক্ষারত্ন সম্মান দেওয়ায় শুধু বাসন্তীর চুনাখালি নয় গর্বিত সমগ্র দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তথা সুন্দরবন।
আগামী ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের দিনই রাজ্য সরকারে তরফে শিক্ষারত্ন সম্মান তুলে দেওয়া হবে শিক্ষক নিমাই মালীর হাতে ।
এই সম্মান প্রাপ্তিতে সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল বলে মনে করেন নিমাই মাষ্টার।