শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুন্দরবনে বাঘের হানায় মৎস্যজীবীদের মৃত্যু, নদীপথে ১০টি বোট নামালো সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০
news-image

বিশ্লেষণ মজুমদার, ক্যানিং –

১০২টি ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবন।জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘের সহযোগে পঞ্চাশ লক্ষের অধিক মানুষের বসবাস এই সুন্দরবনে।এই সুন্দরবন জঙ্গলে ৪০০ প্রজাতির গাছগাছালি ও নদীতে কুমীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, পাখি,জীবজন্তু,বিষধর সাপের আস্তানা। এই বাদাবনের দেশ সুন্দরবনে একদিকে যেমন মানুষের বাস তেমনই ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে ডেরা রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। জীবন জীবিকার স্বার্থে সুন্দরবনের ভূমিপুত্রদের আজও নদী ও খাঁড়িতে মাছ,কাঁকড়া ধরতে হয়।আর এই কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছরই বাঘের আক্রমণে বহু মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে। বৈধ অনুমতি থাকলে মৃত কিংবা আহতের পরিবার সরকারি ক্ষতিপূরণ পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাপ ঠাকুরদার মতনই অনুমতি ব্যতিরেকে নদী-খাঁড়িতে গিয়ে জীবন খোয়াতে হয়।পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর অকালমৃত্যুতে চরম দুর্ভোগে পড়ে গোটা পরিবার।

এমনই দুর্বিষহ অবস্থাই রোজনামচা সুন্দরবনের গোসাবা,বাসন্তী কুলতলি,হিঙ্গলগঞ্জ এলাকার মৎস্যজীবীদের। বছর দশেক আগের আয়লা,ফণি কিংবা বুলবুল সহ সাম্প্রতিককালের আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে সমগ্র সুন্দরবনবাসীর।নুন আনতে পান্তা ফুরানো পরিবার গুলি করোনার আবহে লকডাউনের জন্য পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ হারিয়ে গ্রামে আবার ভিড় জমিয়েছে গ্রামের বাড়িতে। শুধু পেটের তাগিদেই অনেকেই আবার পুরনো পেশাকে বেছে নিয়ে নদীতে,খাঁড়িতে মাছ,কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের শিকার হতে হচ্ছে।পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে শুধু লকডাউনের মধ্যেই প্রায় ১৩ জন মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়েছে বাঘের আক্রমণে।যদিও মৃতদের অধিকাংশই অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিল মাছ কাঁকড়া ধরতে। ফলে নিজেদের অকাল মৃত্যুর পাশাপাশি চরম সঙ্কটে পড়েছে মৎস্যজীবীরা।মৎস্যজীবীদের মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলায় উদ্বিগ্ন বনমন্ত্রী থেকে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধিকর্তারাও। চলতি সপ্তাহেই নতুন করে তিনজন মৎস্যজীবীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটায় জল-জঙ্গল নির্ভরশীল মৎস্যজীবীদের নৌকা নিয়ে নদী খাঁড়ির গভীরে ঢুকে যাওয়া যাওয়া সহ এক গুচ্ছ বিধি নিষেধ সম্পর্কে সচেতন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাতে মাছ,কাঁকড়া ধরতে যাওয়া মৎস্যজীবীদের ওপর নজরদারির পাশাপাশি সচেতন করা যায়।

সোমবারই সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত বসিরহাট রেঞ্জের ঝিলা ২ ও ৪,সজনেখালি রেঞ্জের অন্তর্গত ঝিলা ৬ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকায় পাঁচটি করে মোট দশটি টহলদারি বোর্ড নামানো হয়েছে নদীতে। সেই বোট গুলিতে ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্মীদের পাশাপাশি জয়েন্ট ফরেস্ট মানেজমেন্ট কমিটি(যৌথ বন পরিচালনা সমিতির)সদস্যদেরকেও একসাথে টহলদারি কাজে লাগানো হয়েছে। তবে বিশেষ করে নজর রাখা হচ্ছে যাতে বৈধ অনুমতি ছাড়াই কেউ নদিখাঁড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। সেই সাথে নদীর জলেই দোন ফেলেই কাঁকড়া ধরার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কারণ খাঁড়িতে নৌকা নিয়ে ঢুকে বাঘের নাগালের মধ্যে গিয়েই নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনছে মৎস্যজীবীরা। আবার অনেকে নিয়ম ছাড়াই জঙ্গলে জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। যাতে আর কেউই সরকারি নির্দেশ অমান্য না করে,সেই জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সাথে সাথে শুরু হয়েছে সতর্কতামূলক লিফলেট বিলি ও মাইক প্রচারও। এদিন বনকর্মীদের তরফে হরিণ ভাঙ্গা নদী,দত্তা নদীতে সেই সচেতনতা বার্তা দেওয়া হয় সাধারণ মৎস্যজীবীদের। ব্যাঘ্র প্রকল্পের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার যৌথ বন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থাকা হিমাংশু মন্ডল। তিনি জানিয়েছেন ‘সাম্প্রতিক কালে বাঘের আক্রমণে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় আমরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। মানুষকে নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের এই সচেতনতামূলক উদ্যোগ মৎস্যজীবীদের বোঝাতে পারলে অনেকটাই সুবিধা হবে।’
এই প্রসঙ্গে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা তাপস দাস জানিয়েছেন ‘আগে মানুষ কে সচেতন হতে হবে।জীবন জীবিকার থেকে জীবনটাই অনেক বড়। আর সেই জন্যই বাঘের ডেরায় গিয়ে মাছ,কাঁকড়া না ধরার থেকে নদীতে ধরলে সেক্ষেত্রে বাঘের হাত থেকে নিজেদের জীবনকে রক্ষা করা যাবে। বাঁচবে পরিবারও। সেই কারণেই আমরা দশটি বোটকে নদীপথে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে লাগিয়েছি। দপ্তরের কর্মীদের সাথে থেকে সেই কাজ করছে যৌথ বন পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও’।