বুধবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কেমন আছে মধু? লকডাউনে সূদুর আসানসোলের জসিডি থেকে খোঁজ নেন বিজয় কুমার

News Sundarban.com :
আগস্ট ২৮, ২০২০
news-image

বিশ্লেষণ মজুমদার

মধু নামক এক প্রতিবন্ধী গোরু আর শিবা নামক এক দরিদ্র হকার।প্রায় বছর তিনেক হল দুজনের মধ্যে একে অপরের সাথে এক অন্তরাত্মা গড়ে উঠেছে । ঘটনাটা ছিলো বিগত বছর তিনেক আগে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ।শিবা ওরফে শিকান্দর সাহানী।সুন্দরবনের সিংহ দূয়ার নামে খ্যাত ক্যানিং ষ্টেশন। জীবন জীবিকার তাগিদে এই ক্যানিং ষ্টেশনেই হকারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন শিবা।একদিন সকালে ডাউন শিয়ালদহ -ক্যানিং লোকাল ট্রেনটি ক্যানিং ১ নম্বর প্লাটফর্মে ধীরগতিতে ষ্টেশনে ঢুকছে।তখন মধু তার মায়ের সাথে ষ্টেশনের পাশেই ঘুরছিল। আচমকা ট্রেনের বাঁশির শব্দে একদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে মধু।একটা সময় ট্রেনের চাকার তলায় পড়ে যায় মধু। তার বামদিকের পিছনের একটি পা কেটে যায় দুর্ঘটনায়।মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে সে। মানুষ নয়!অবলা জীব। তাই সাধারণ মানুষজন থেকে ট্রেনের নিত্য যাত্রীরা এমন কাকতালীয় দৃশ্য দেখে সামান্য একটু হা-হুতাশ করে যে যর মতো গন্তব্যে রওনা দিয়ে দেয়।ইতি মধ্যে এমন দুর্ঘটনার কথা জানতে পারে হকার শিবা। দোকান বন্ধ করে দৌড়ে যায় ঘটনাস্থলে।দুর্ঘটনায় মধুর ক্ষতবিক্ষত বাম পা নিজেই কেটে বাদ দিয়ে দেয়।রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না দেখে নিজের পরনের লুঙ্গি ছিঁড়ে মধুর বামপায়ে বেঁধে দেয়। দৌড় লাগায় স্থানীয় এক পশু চিকিৎসকরের কাছে।যদি কোন রকম অসুবিধা হয় সেই কারণে রেল দুর্ঘটনা আহত পশু চিকিৎসক মধু নামক গোরু কে চিকিৎসা করতে রাজী নন। এমতো অবস্থায় পশু চিকিৎসক কে হাতে পায়ে ধরে রাজী করাতে সক্ষম হয় শিবা।পশু চিকিৎসক এসে তড়িঘড়ি মধুর বাম পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ১৬ টি সেলাই করে পুণরায় ব্যান্ডেজ করে দেয়। বেশকিছু ওষুধপত্রও লিখে দেন চিকিৎসক।

হকারী করে সেদিনে শিবার আয় হয়েছিল মাত্র ৫৪০ টাকা। ওষুধ কিনতে হবে ৭৮০ টাকার! অগত্যা পরিবারের কথা উপেক্ষা করে নিজের সমস্ত আয়ের টাকা দিয়ে এবং স্থানীয় হকারদের কাছে সাহায্য নিয়ে সমস্ত ওষুধ কিনে আনে শিবা।ইতি মধ্যে গোলবাধে মধু খাবে কি ?থাকবে কোথায়?মহাফাঁপরে পড়ে যায় শিবা ওরফে সিকান্দর সাহানী।ওষুধ কিনে নিয়ে গিয়ে মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলে শিবা। এই মনে হয় আর হয়তো মধু কে বাঁচানো যাবে না!ইতিমধ্যে বেশকিছু কৌতুহলি মানুষজন এমন কৌতুহল দেখার জন্য ভীড় জমিয়েছে।ঘন্টা খানেক এমন মর্মান্তিক ঘটনার নাটক চলতে থাকায় নজরে পড়ে ক্যানিং ষ্টেশনের কর্তব্যরত আরপিএফ পুলিশের। জনতার ভীড় দেখে এগিয়ে আসেন আরপিএফ কর্মী বিজয় কুমার।পুলিশ আসছে দেখেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভীড় উধাও হয়ে যায়।বিজয় কুমার শিবার কাছে সমস্ত ঘটনার কথা জানতে পারেন। সমস্ত ঘটনা শোনার পর তিনি শিবার সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তিনি।

এক মুহূর্ত দেরী না করে আরপিএফ কর্মী বিজয় কুমার নিজেই তাঁর কোয়ার্টার থেকে বেডকভার,মাদুর এবং মুসারী নিয়ে এসে শিবার হাতে তুলে দেয়। পাশাপাশি ক্যানিং ষ্টেশন সংলগ্ন একটি গাছের তলায় মধুকে রেখে সুস্থ করে তোলার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।আরপিএফ বিজয় কুমার আর হকার শিবার মাতৃস্নেহের পরিচর্যায় মধু প্রায় তিনমাস পর থেকে একা একা চলতে শুরু করে। মধু একা চলতে পারে দেখে বিজয় কুমার ও শিবার চোখে আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়ে।এতোদিনে তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টা সার্থক হলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন দুজন।একদা চাকরি সুত্রে বিজয় কুমার বদলি হয়ে আসানসোলের জসিডিতে চলে গেলেও কেমন আছে মধু? ফোন করে খোঁজ নেন। অন্যদিকে শিবাও প্রতিদিন মধুর খোঁজ রাখে।মধু কোথায় যাচ্ছে? কি করছে?কাদের সাথে বেড়াচ্ছে?

তবে শিবার আর কোন চিন্তা নেই। মধু বর্তমানে ক্যানিং ষ্টেশন এলাকায় দাপটের সাথে রাজত্ব করে। তার ধারে কাছে অন্যান্য কোন ভবঘুরে গোরুর দল আসতে সাহস দেখায় না।তবে সারাদিনে একবার হলেও মধুর সঙ্গে শিবার সাক্ষাৎ হবেই হবে।আর শিবা কে দেখতে পেলেই মাতৃস্নেহের মতো আদর খাওয়ার জন্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিন পায়ে ভর করে দৌড়ে আসে শিবার কাছে।মিনিট দশেক পরই আবার দুজন দুদিকেই রওনা দেয়।শিবার সাথে মধুর দেখা হবে আবার হয়তো আগামী কোন এক নতুন সূর্যোদয়ের সকাল বেলায়।