বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

 ভেঙে যাওয়া মুসলিম পরিবারের সংসার জোড়া লাগালেন হিন্দু যুবক

News Sundarban.com :
এপ্রিল ২৭, ২০২০
news-image

সুভাষ চন্দ্র দাশ,ক্যানিং —

রমজানমাসের শুরুতেই খুশির জোয়ার। করোনার তান্ডবে ভেঙে পড়েছিল এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম দম্পতির সংসার। আর সেই ভেঙে যাওয়া সংসার কে শেষ মুহূর্তে জোড়া লাগালেন এক হিন্দু যুবক।তাও আবার রমজান মাসের শুরুতে এমন সাফল্য।আর এমনই বৈচিত্রময় ঘটনায় আরো একবার সম্প্রীতির বার্তা বহন করলো।প্রমাণিত হল জাত ধর্ম কিছুই নয়। সকলের উর্দ্ধে মানবতা।জোড়া লাগা সংসার শুরু হতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন উভয় পরিবার।কেন একটি সংসার ভেঙে গিয়েছিল ? ঠিক কি ঘটেছিল এবং ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষ দায়ীই বা কে?

জানাগেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ক্যানিং থানার হাটপুকুরিয়া পঞ্চায়েতের ডেভিসাবাদ গ্রাম।এই গ্রামের লস্কর পাড়ায় স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে বসবাস করেন আবুহাসেম লস্কর। বিগত বছর তিনেক আগেই তার বড় মেয়ে নাসিফা লস্কর কে বিয়ে দেন কলকাতার ইকবাল পুরের ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা যুবক সাদ্দাম হোসেনের সাথে।সাদ্দাম পেশায় একজন ব্যবসায়ী।বিবাহের পর এই দম্পতি আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন।বিগত প্রায় ছয় মাস আগে এই দম্পতির সংসার উজ্জ্বল করে এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হয়।সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। ইদানিং আচমকা করোনার জেরে শুরু হয়েছে লকডাউন। আর এই লকডাউন শুরুর দিনতিনেক আগেই ছোট্ট শিশু সন্তান আসজাদ হোসেনকে নিয়ে গ্রামে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন নাসিফা।এরপর লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় স্বামীর সংসারে আর ফিরতে পারেন নি।স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য সমস্ত চেষ্টা করলেও সফল না হয়ে ভেঙে পড়েন নাসিফা ও তার বাপের বাড়ির লোকজন।অন্যদিকে নাসিফার স্বামী সাদ্দাম ও ফোন করে নাসিফা কে জানায় শিশু সন্তান সহ তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে না আসলে সংসার ত্যাগ করে ডিভোর্স দিয়ে দিতে পিছপা হবে না সে। অগত্যা আরো মহাফাঁপরে পড়ে যায় নাসিফা ও তার বাপের বাড়ির লোকজন।চিন্তা খাওয়া দাওয়া ঘুব সব কিছুই উবে যায়। শ্বশুর বাড়ির লোকজন সাদ্দাম কে ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা জানালেও সাদ্দাম সে সব কথা তোয়াক্কা না করে নিজের জেদ বজায় রাখে। এমত অবস্থা নাসিফার বাবা আবুহোসেন লস্কর বিভিন্ন ভাবে মেয়ে কে তার স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা বিফলে যায়।মেয়ের সংসার ভেঙে যাবে ভেবেই চিন্তায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন।ইতি মধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় থেকে জানতে পারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় পরিবারের বাড়িতে বাড়িতে ওষুধ খাদ্য সামগ্রী বিনা পারিশ্রমিকে পৌঁছে দিচ্ছেন ক্যানিংয়ের যুবক সমরেশ দোলুই। এমন খবর জানতে পেরে সোস্যাল মিডিয়া থেকে সমরেশ দোলুই এর ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করেন আবুহোসেন।দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগ করেও কোন প্রকার সাহায্য না পেয়ে আরো ভেঙে পড়েন।
রবিবার ভোরে আচমকা সমরেশ বাবু তার বাইক হাঁকিয়ে হাজীর হন আবুহোসেনের বাড়িতে।দরজার কড়া নেড়ে ডাকাডাকি শুরু করেন। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসেন আবুহোসেন ও তার স্ত্রী তাইকাসুম বিবি।সমরেশ জানায় ভাঙতে বসা সংসার যেনতেন প্রকারে জোড়া লাগাবেন।সেই মতো প্রস্তুতি নিয়ে নাসিফা ও তার ছয় মাসের শিশু সন্তান আসজেদ হোসেনকে সেই মুহূর্তে নিজের বাইকে চাপিয়ে রবিবার ভোরের সুর্যোদয়ের আগেই রওনা দেন সাদ্দামের ইকবাল পুরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ প্রায় নব্বই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাদ্দামের বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছে যায় সমরেশ।তখনও ভোরের আলো ঠিকমতো ফোটেনি। রাস্তার একপাল কুকুর অজানা অচেনা লোকজন দেখেই ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে।নাসিফা বাইক থেকে নেমে সাদ্দাম কে ডাকাডাকি শুরু করে। একদিকে রাস্তার কুকুরদের ঘেউ ঘেউ বিরক্তিকর শব্দ আর অন্যদিকে ভোর বেলায় মহিলার ডাকাডাকিতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় সাদ্দামের। বাইরে বেরিয়ে দরজার সামনে আসতেই চমকে ওঠেন।রমজান মাসের শুরুতেই স্ত্রীকে সামনে দেখে নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এমন কান্ডে অবাক হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে সাদ্দাম। সামনে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী সন্তান ও এক বহিরাগত যুবক। কি করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেনা না সাদ্দাম। দরজা খুলেই শিশু সন্তান ও স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। কেঁদে ফেলেন নাসিফাও। স্বামী-স্ত্রীর কান্না দেখে গর্বে বুক ফুলে ওঠে যুবক সমরেশের।আনন্দে সমরেশে মুখে ফুটে ওঠে একরাশ হাসি।
লকডাউন চলায় দীর্ঘ প্রায় একমাস পর নিজের স্ত্রী সন্তানকে কাছে পেয়েছে,এমন খবর ভোরেই পৌঁছে যায় প্রতিবেশীদের কাছে। তারা ছুটে আসেন দেখতে। নাসিফা কিংবা তার শিশু সন্তান কে দেখতে নয়।ভেঙে যাওয়া সংসার জোড়া লাগানো যুবক সমরেশ কে দেখতে ভীড় জমান। তারা বাহবা দিতে থাকেন।
সাদ্দাম জানায় “দুএকদিনের মধ্যে স্ত্রী শিশু সন্তানকে কাছে না পেলে ঠিভোর্স দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আইনজীবীর সাথে কথা বলেছিলেন। তৈরী করছিলেন ডিভোর্সের প্রক্রিয়াও।স্ত্রীকে কাছে পেয়ে স্বভাবতই সেসব কথা ভুলে গেছেন সাদ্দাম। অন্যদিকে মেয়েকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন পেশায় দর্জি আবুহোসেন লস্কর ও তার স্ত্রী তাইকাসুম বিবি।
লকডাউনের জেরে ভেঙে যাওয়া সংসার জোড়া লাগাতে পেরে খুশি সমরেশ ও। তিনি বলেন “সংসার ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সংসার জোড়া লাগাতে সময় লাগে। আজ এই করোনা মহামারী বিপর্যয়ের সময়ে দাঁড়িয়ে পবিত্র রমজান মাসের শুরুতে একটি মুসলিম পরিবারের সংসার জোড়া লাগাতে পেরে খুব খুশি।“