শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৩০০ বছরের  অশ্বত্থ বৃক্ষ ঘিরে রহস্য,আজও পুজিত হয় সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে

News Sundarban.com :
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০
news-image

সুভাষ চন্দ্র দাশ,ক্যানিং

রহস্যে ঘেরা প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষ।আনুমানিক প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন এই অশ্বত্থবৃক্ষ অবস্থিত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রত্যন্ত বাসন্তী ব্লকের চুনাখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের আদিবাসী অধুষ্যিত পুকুরপাড়া গ্রামে।১৯৮৬ সালের সাইক্লোন ঝড়,২০০৯ আয়লা কিংবা ২০১৯ এর ফণী,বুলবুল ঝড় দাপট দেখালে গ্রামের বড় বড় গাছপালা ভেঙে ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রাচীন এই অশ্বত্থ গাছের গায়ে কোন আঁচড় কাটতে পারেনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।এই অশ্বত্থবৃক্ষ ঘিরে আজও গ্রামের মানুষজন পূজোয় মেতে ওঠেন।জমায়েত হন বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ। বিগত প্রায় ১২০ বছর আগেই বাসন্তীর এই পুকুরপাড়া গ্রামে “ওলাউঠা”(ডাইরিয়া) ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।সেই সময় প্রত্যন্ত এই এলাকায় চিকিৎসা পরিষেবা বলতেই কিছুই ছিল না। গ্রামের মধ্যে ওলাউঠার দাপটে এক সপ্তাহের মধ্যে ৩২ জন মারা যায়।যার মধ্যে ২০ জন ছিলেন মহিলা। সমগ্র গ্রামে কান্নার রোল ওঠে।কে কাকে শশ্মানে নিয়ে যাবে এমন প্রশ্ন দেখা দেয়। কারণ মানুষের মধ্যে তখন প্রচলিত ছিল ওলাউঠা তে মৃত্যু হলে সেই মৃতদেহ কে ছোঁয়া মানে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হবেই।অগত্যা তৎকালীন গ্রামের মোড়লদের কথামতো নদীর ধারে,খালপাড় কিংবা মাঠের মধ্যে মৃতদেহ গুলি পুঁতে ফেলেন পরিবারের লোকজন।এর পর ও ওলাউঠা মহামারী আকার ধারণ করে। ধারাবাহিকভাবে গ্রামের মধ্যে মড়ক শুরু হয়।এক সপ্তাহে ৩২ জনের মৃত্যুর পরও আবার মড়ক শুরু হওয়ায় প্রমাদ গোনে পাড়ার মোড়ল মাতব্বরেরা।গ্রামের সকল বাসিন্দাদের নিয়ে গ্রামের প্রাচীন অশ্বত্থগাছের নীচে বসে মিটিং।মিটিং চলাকালীন অশ্বত্থ গাছের নীচেই ওলাউঠায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এক মহিলা। সকলেই ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।ভয়ের পাশাপাশি গ্রামের মোড়ল মাতব্বরাও অন্যত্র পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে থাকেন।এরপর গ্রামে প্রায় প্রতিদিনই ওলাউঠায় মড়ক শুরু হয়। এরপর পাড়ার বিশিষ্ট মোড়ল মাতব্বর গোবিন্দ বৈরাগী, গিরীশ মাঝি, শরৎ অধিকারী,নকুল সরদার,নিতাই বৈরাগী, সন্ন্যাসী বৈরাগী, কাঙালী সরদার, অমূল্য সরদার, গুপীনাথ সরদার, ধীরেন অধিকারী, শচীন্দ্র সরদার সহ একাধিক মানুষজন স্থানীয় প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষ সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে অশ্বত্থ গাছের নীচে গ্রামে শান্তির জন্য মানত করেন।পাশাপাশি
পুকুরপাড়া গ্রামের সকল গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে দেবতাকে তুষ্ট করার প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হন।
শুরু হয় অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে পুজো দেওয়া তোড়জোড়।দুইদিন ধরে নিরামিষ ভোজন সহ অরন্ধন পালিত হয় সমগ্র গ্রামে। পুজোর পরই গ্রামে ওলাউঠা একেবারেই নির্মূল হয়ে যায়। শান্তিতেই বসবাস শুরু করেন গ্রামবাসরী। কিছুকাল পর দুঃর্ভিক্ষের জন্য বছরদুই এই পুজো বন্ধ হয়ে যায়।
আবার গ্রামের মধ্যে অশুভ ঘটনা ঘটতে শুরু করে। পরপর ওলাউঠায় আক্রান্ত হয়ে গ্রামে শুরু হয় মড়ক।আবারও গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে যজ্ঞানুষ্ঠান শুরু করেন গ্রামের মানুষজন পুজো করেন প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ কে।
এলাকার প্রবীণ মানুষজনের মতে এটাই চুনাখালি তথা বাসন্তী ব্লকের প্রাচীনতম অশ্বত্থবৃক্ষ। আর সেই অতীতের রীতিনীতি অনুযায়ী গ্রাম তথা এলাকার মঙ্গলের জন্য উঁচু নীচু জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একসাথে মিলিত হয়ে পুজো করেন প্রাচীন এই অশ্বত্থবৃক্ষ কে।অনুষ্ঠিত হয় যঞ্জ ,নাম সংকীর্তন এমন কি ধূনা পোড়ানো থেকে দন্ডী কাটাও।
চিরাচরিত প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী দুই দিনে সেই পুজো শেষ হল মঙ্গলবার রাতে।
অশ্বত্থ বৃক্ষ পুজো প্রসঙ্গে এলাকার বর্তমান প্রজন্মের বাসিন্দা দেবাশীষ বৈরাগী প্রদীপ সরদার, রাম সরদার, স্নেহাশীষ বৈরাগী, রবীন সরদার, বিমল অধিকারী, বিশ্বনাথ সরদার, চিরঞ্জিত সরদাররা বলেন “পুর্বপুরুষদের স্মৃতি মন্থন করে হাসিমুখে ঈশ্বরের সেবা সহ দরিদ্র নারায়ণ সেবার কাজে নিয়োজিত হই। আজও আমরা সকলে এই প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের নীচে মিলিত হয়ে পুজো দিয়ে থাকি গ্রামের মঙ্গল কামনায়।”