বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আবর্জনার স্তূপে নবজাতক, মিললো ১৬ শিশু

News Sundarban.com :
ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০
news-image

চট্টগ্রাম  প্রতিবেদন : নবজাতক শিশুরা জন্মের পর চার দেয়ালের ভেতর নরম বিছানা বা মাতৃকোলে থাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কিছু নবজাতক পৃথিবীর মুখ দেখে নির্মমতা সঙ্গী করে। তাদের ঠাঁই হয় না নরম বিছানা বা মায়ের কোলে। পৃথিবীর আলোটাই তারা দেখে ডাস্টবিন, নালা, ময়লার স্তূপ বা কুকুরের মুখে। চলার পথে এমন অনেক শিশুর দেখা মেলে। এদের কেউ মরে বেঁচে যায়, কেউ বেঁচে মরে থাকে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় চলতি বছর জানুয়ারিতে ৩ জন এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ জন নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া গেছে। এদের কেউ পথের ধারে, কেউ রেললাইনে, কেউ ময়লার স্তূপে, আবার কাউকে পাওয়া গেছে ডাস্টবিনে। যা খুবই অমানবিক। এর অন্যতম কারণ মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরা কিছু নরপিশাচের লালসার শিকার হন এবং কিছু তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকার ভুল সিদ্ধান্ত। পুরুষরা সন্তানকে অস্বীকার করার কারণে নারীরা বাধ্য হয় সন্তান নষ্ট করতে বা অপরিণত অবস্থায় অপারেশনের মাধ্যমে সন্তানকে হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে যেতে।৩১ জানুয়ারি (শুক্রবার) সকাল ৯টায় ডবলমুরিং থানার রেলওয়ে ডকইয়ার্ড রেললাইনের পাশ থেকে সদ্য ভূমিষ্ট নবজাতক ও নবজাতক শিশুর মা মানসিক ভারসাম্যহীন রিনা আকতারকে (৩০) উদ্ধার করে ডবলমুরিং থানার পুলিশ, ১৯ জানুয়ারি নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার মোস্তফা কলোনির পশ্চিম শহীদনগর ওয়েল মিলস জিসি ফ্যাক্টরির পাশে ময়লার স্তূপ থেকে এক নবজাতক শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে পুলিশ। চিকিৎসার পর অভিভাবকহীন নবজাতকটিকে চমেক হাসপাতাল থেকে লালন-পালনের জন্য রৌফাবাদ সরকারি ছোট মণি শিশুনিবাসে পাঠানো হয়, ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আগ্রাবাদের গ্রামীণ ফোন সেন্টারের সামনে রাস্তার উপর সন্তান প্রসব করেন মানসিক ভারসাম্যহীন রোজিনা। এরপর রাস্তা থেকে তাদের পুলিশ উদ্ধার করে। বর্তমানে শিশুটি একটি পরিবার লালন পালন করছে।

৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিমচাল কবিরার দোকান এলাকায় রাস্তার পাশে রাতের আঁধারে এক মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী প্রসব বেদনায় গগনবিদারী চিৎকার শুনে গন্তব্যে ছুটে যান এলাকাবাসী। পরবর্তীতে কয়েকজন মহিলা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে গেলে মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারী এক নবজাতক ছেলে শিশুর জন্ম দেন।

১৮ নভেম্বর হালিশহরের এইচ ব্লকে দুপুরে ড্রেনের পাশে ময়লার স্তুপে সদ্য জন্ম নেওয়া এক নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে বাচ্চাটি মারা যায়, ১৭ নভেম্বর চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেইটের পাশে একটি ডাস্টবিনে দুটি অপরিণত বাচ্চাকে কুকুরের দল থেকে উদ্ধার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ, ৩ নভেম্বর সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের জোড়ামতল এলাকায় সড়কের পাশ থেকে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

১৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গার নাজিরপাড়া এলাকার সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের (এসএপিএল) পাশে রাস্তার থেকে এক নবজাতককে উদ্ধার করেন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর শাহানূর বেগম। তখন নবজাতকের মানসিক ভারসাম্যহীন মা পাশে ছিল। উদ্ধারের পর নবজাতককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কাউন্সিলর নিজেই এই শিশুটির পরিচর্যা করছেন। ২ অক্টোবর সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের বন্দরের ইস্ট কলোনির ড্রেন থেকে অপরিণত এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ।

১৬ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টায় সার্কিট হাউজের দেয়ালের পাশে ব্যাগের ভেতর থেকে ৪০ দিনের এক শিশু উদ্ধার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ।

২০ আগস্ট আগ্রাবাদ এলাকায় ভোরে মানসিক ভারসাম্যহীন আয়েশা (২৬) সন্তান প্রসবের পর ছুঁড়ে ফেলে দেন রাস্তার পাশে। এরপর সেই বাচ্চাকে কুকুর নিয়ে টানাটানি করলে তাকে রক্ষা করেন ডবলমুরিং থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর নবজাতক এবং মা দুজনকেই চমেক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

২৮ জুন লোহাগাড়ার পদুয়ার মাদ্রাসা সড়কের পাশে রাত ৮টায় নবজাতক কন্যাশিশু পাওয়া যায়। ১৩ জুন আনোয়ারা উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের টয়লেটের বাইরে সকাল ৮টায় নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

২২ মে চট্টগ্রামে নালা থেকে জীবিত একজন এবং ডাস্টবিন থেকে মৃত দুই নবজাতককে উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের কর্নেলহাট এলাকার ডাস্টবিনে পাওয়া যায় আরেক নবজাতক। তার নাম রাখা হয়েছিলো একুশ।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) শ্যামল কুমার নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, এটি একটি সামাজিক সমস্যা। মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরা রাস্তায় থাকার কারণে নানাভাবে ধর্ষণের শিকার হয়। ফলে এসব নবজাতকের পিতৃ পরিচয় পাওয়া যায় না। আসল অপরাধীরা থেকে যায় অধরা। আর ভারসাম্যহীন ওইসব মহিলারা সন্তানের মায়া না বুঝার কারণে তাদের রাস্তায় ফেলে চলে যায়।

তিনি আরও বলেন, আবার কিছু কিছু তরুণ-তরুণী আছে যাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তরুণী গর্ভবতী হয়ে যান। এ সময় বেশিরভাগ প্রেমিক তার প্রেমিকাকে অস্বীকার করে। পরবর্তীতে সে তরুণী সমাজের কাছে হেয় হওয়ার ভয়ে গর্ভপাত করান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, বয়সের সাথে সাথে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যেমন পরিবর্তন ঘটছে, তেমনি মন মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটছে। মানুষ অনেক কিছু পেতে চায় সে প্রাপ্তির যদি সংযোগ না ঘটে তাহলে মানুষ অন্য পন্থা অবলম্বন করে। যার কারণে মানুষ পরকীয়া করে, ধর্ষণ করে, জোর করে প্রেম নিবেদন করে, প্রেম আদায় করে। এ অপসংস্কৃতিগুলো তাদের অতিমাত্রায় উৎসাহিত করছে এবং প্রণোদিত হচ্ছে বিধায় এক ধরনের ভারসাম্যহীন বা অল্প বয়সী যাকে যেখানে পাচ্ছে তাদের শিকার করে নিচ্ছে। এসব তারা এতই অসচেতনভাবে করছে যার কারণে তারা কোনও পদ্ধতি ব্যবহার করে না। যাতে করে গর্ভে সন্তান জন্মায়। পরবর্তীতে মানসিক ভারসাম্যহীনরা রাস্তায় সন্তান প্রসব করে। এর ফলে এসব শিশু রাস্তায় পড়ে থাকে বা পথশিশু হিসেবে বেড়ে উঠে।

তিনি আরও বলেন, যারা সুস্থ স্বাভাবিক কিশোর-কিশোরী বা তরুণ- তরুণী তাদের অনেকেই গর্ভপাত করছে। এমন কিছু নির্লজ্জ বেহায়া এনজিওর স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসক আছে যারা বিপরীত পন্থায় গর্ভপাত করে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষ সুযোগ পাচ্ছে গর্ভপাত করার। যদি এটি বন্ধ করা যায় তাহলে এসব করার সুযোগ পাবে না।