বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মান্না দে’র চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া সঙ্গীত গবেষক দেবপ্রসাদ দাস

News Sundarban.com :
অক্টোবর ১৮, ২০১৯
news-image

 বিবেকানন্দ বসাক

ভারতীয় সাধক শ্যামাচরণ লাহিড়ী, রামদাস কাঠিয়াবাবা, নিগমানন্দ থেকে শুরু করে কোরান, উপনিষদ, বাইবেলের ইংরেজি সংস্করণ এমন বহু ধর্মীয় বই তাঁর বাবার সংগ্রহে ছিল। বইয়ের তালিকায় বৌদ্ধধর্মও বাদ যায়নি।প্রতিটি হিন্দুবাড়ির মতো শ্রীমদ্ভগবতগীতা লাল কাপড়ে পেঁচিয়ে ঠাকুরের আসনে রাখার রীতি অবশ্য এ বাড়িতে ছিল না। তখন থেকেই বই পড়ার নেশা সঙ্গীত গবেষক দেবপ্রসাদ দাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তারপর আর বেরিয়ে আসতে পারেননি। বাবা অনুকূলচন্দ্র দাসের মতো ছোটবেলা থেকে পড়াশুনোর পাশাপাশি বিভিন্নরকম বই পড়ার দিকে ঝোঁক ছিল দেবপ্রসাদবাবুর। রেলের আধিকারিক বাবার বদলির চাকরি ছিল। গুয়াহাটির রেল কোয়ার্টারে থাকতেন তখন। বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার কীর্তন হত। তাঁর বাবা তো কীর্তন গাইতেনই। ঠাকুরদাও গাইতেন।

আর মা মাধবী দাসের গলাও ছিল সুমিষ্ট। ফলে সাহিত্য আর গান রক্তে ঢুকে যায়। ‘উল্টোরথ’, ‘সিনেমা জগৎ’, ‘ঘরোয়া’ প্রভৃতি পত্রিকা বাড়িতে নিয়মিত আসত। এর মধ্যে পত্রিকায় ছাপা গানের আলোচনা তাঁকে বেশি টানত। গান শেখার পাশাপাশি গানের সাহিত্য পড়ার আকর্ষণ বেশি ছিল। রবিশঙ্করের ‘রাগ অনুরাগ’ সহ যে কোনও গান সংক্রান্ত বই পেলে পড়ে ফেলতেই হবে। ১৯৮২ সালে আলিপুরদুয়ার জংশনে গান গাইতে আসেন এবং সেই সূত্রে অফিসার্স ক্লাবে উঠেছিলেন। বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে হালকা আলোচনা হয় তাঁর সঙ্গে।এরপরই মাথায় এলো তাঁকে নিয়ে বই লেখার কাজ শুরু করা যায় কি না। যে কথা সেই কাজ। আলিপুরদুয়ার জংশনে থেকে কী করে মান্না দে’কে নিয়ে কাজ করা সম্ভব? এই প্রশ্ন তাঁর মনেও উঁকি দিয়েছিল। এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালে অরুণাচল প্রদেশে সরকারি চাকরি জুটে গেল। ফলে দূরত্ব শতযোজন বেড়ে গেল। ১৯৮৯ সালে লামডিঙে আসেন মান্না দে। দ্বিতীয়বার তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর আত্মজীবনীর অনুলিখনের কাজ করবেন বলে প্রস্তাব দেন। মান্না দে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলেন না অরুণাচল প্রদেশ থেকে কীভাবে মুম্বইয়ে যোগাযোগ রাখবেন দেবপ্রসাদ? তাও আবার ব্যস্ততম শিল্পী বলে কথা। সেই অসম্ভব কাজ অবশ্য সম্ভব করেছিলেন দেবপ্রসাদবাবু।

কলকাতায় মান্না দে একবার দেবপ্রসাদবাবুকে সময় দেন। টেপ রেকর্ডার নিয়ে সমস্ত কাহিনি তিনি অনেকগুলো ক্যাসেটে রেকর্ড করেন।তারপর নিজের মতো করে গুছিয়ে তা লিখে ফেলেন। সমস্ত লেখা তাঁকে পাঠান।লেখা পড়ে অভিভূত মান্না দে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এরপর দীর্ঘসময় মান্নাবাবুর অনেকগুলো চিঠি ডাকে বিভিন্ন সময় এসেছিল। সেই অপ্রকাশিত চিঠি অবশ্য তাঁর একান্তই সম্পদ। ১৯৯৭ সালে দেবপ্রসাদ দাসের অনুলিখন ও সম্পাদনায় “আমি নিরালায় বসে” মান্না দে’র আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয়। সেই শুরু। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।দশকের পর দশক গভীর গবেষণায় বুঁদ হয়ে থাকলেন এই মানুষটি। মান্না দে’র চলন্ত এন সাইক্লোপিডিয়া দেবপ্রসাদ দাস ২০০১ সালে প্রকাশ করলেন আরও একটি বই “মেরা সব কুছ মেরে গীত রে”। মান্না দে’র গানের ডিসকোগ্রাফি এটি। ২০০৭ সালে “মান্না ওয়ার্ল্ড” প্রকাশ করেন। অর্থাৎ এক সিডিতে মান্না দে’র আর্কাইভ। অরুণাচল প্রদেশ থেকে আলিপুরদুয়ার হয়ে কলকাতা পৌঁছে তথ্য সংগ্রহ করা বড়ই দুরূহ কাজ। কিন্তু জেদ আর ক্লান্তিহীন অধ্যবসায়কে পাথেয় করে দুর্গম পাহাড় ডিঙিয়ে ফেলেছেন।২০১৪ সালে প্রতিভাস থেকে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখা মান্না দে’র জীবনীমূলক বই ” ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে”। গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক যুগশঙখ’, ‘সংবাদ লহরি’তে তিনি মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, বেগম আখতারকে নিয়ে লিখেছেন। মান্না দে’র মৃত্যুতে তাঁকে নিয়ে কলকাতার দৈনিক ‘স্বভূমি’ পত্রিকায় লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার দৈনিক ‘একদিন’ পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে। তাঁর দোতলার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটিতে অসংখ্য গানের বই, বুকলেটে ঠাসা। কারও বিরুদ্ধে অভিমান, অনুযোগ নেই। তবুও শিল্পীসত্তার কোন গভীরে হয়তো রিনরিন করে বেজে চলেছে সেই বিষাদের সুর, “…একী বেদনার মতো বেজেছে আবার হারানো দিন।”                                            –পরবর্তী অংশ আগামী শুক্রবার