শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি হাজার পঁচিশেক বেতনের চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৯
news-image

আগামী অংশের পর

প্যারিসে একটা সেমিনারের দাওয়াত পেয়েছি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনজারভেশনের ওপরে। তক্কে তক্কে ছিলাম। সারাক্ষণ ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখি, কোথায় কী হয়। এটা হয়ে গেল। টিকিট অর্গানাইজাররা পাঠিয়েছে।

প্লেনে বসে আছি। বাঁ দিকে দুটো সিট। আমি পেয়েছি আইল। আমার বাঁ পাশে জানালার সিটটা ফাঁকা। যেন ফাঁকা থাকে। তাহলে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যাবে। কোনো মোটা মানুষ যদি এই সিটে বসে আর মধ্যখানের কমন হাতলে যদি হাত রাখে, আমি মারাই যাব।

মাঝখানে একটা রোমশ হাত, মোটা মানুষটার থলথলে পা আমার পায়ে ঠেলছে, তার গায়ে বদবু…ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে আছি। ঘুম পাচ্ছে।

এই সময় মধুক্ষরা কণ্ঠ, ‘এক্সকিউজ মি…আপনার পাশের সিটটা আমার…’

এইবার আমার অক্কা পাওয়ার পালা। নাতাশা হাবিব…বিড়বিড় করে বললাম, ‘নাতাশা হাবিব…’

‘আপনি আমাকে চেনেন?’

‘হ্যাঁ। আপনি ইউনেসকোর প্রজেক্টে আছেন।’

‘কীভাবে জানলেন?’

‘আপনি ঠিকঠাকভাবে বসেন। বলছি।’

নাতাশা হাঁপাচ্ছেন। বললেন, ‘জ্যামে পড়েছিলাম। অল্পের জন্য ফ্লাইট মিস করিনি।’

তিনি তাঁর হাতের ট্রলি মাথার ওপরে রেখে বসলেন আমার পাশে।

আমি বললাম, ‘আপনার মেয়ে কেমন আছে? সুকন্যা?’

‘ও আসলে আমার বোনের মেয়ে, কিন্তু ও আমার জানটুস…আছে ভালো।’

‘কার কাছে থাকবে?’

‘ওর মায়ের কাছে থাকবে। আমাকে মিস করবে। কারণ, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ তো সব সময় বেশি হয়। ’

প্লেন আকাশে। বেশ রাত এখন দেশে। প্লেনের ভেতরের বাতিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি ঘুমুতে পারছি না। আমার পাশে একটা বুনো গন্ধ। আর পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ। দুটো মিলে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। তারপর ঘুম ভাঙল। দেখি, নাতাশা আমার হাতের ওপরে হাত রেখে খামচে ধরে আছেন। ঘুমুচ্ছেন। বিড়বিড় করছেন।

একসময় আলো জ্বলে উঠল। বিমানসেবিকারা স্ন্যাকস দিচ্ছেন। নাতাশাও জাগলেন।

‘ইশ্‌, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ এরপর বললেন, ‘আপনি কই যাচ্ছেন?’

‘প্যারিস।’

‘ওমা, আমিও তো প্যারিস। প্যারিসে কী?’

‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনফারেন্সে।’

‘ওমা আমিও তো…আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল বলুন তো।’

‘না। বলব না। আপনি কেন মনে রাখেননি। আমি তো একটি দিনের জন্যও ভুলিনি।’

প্যারিসে আমরা একই ট্যাক্সিতে একই হোটেলের লবিতে নামলাম। হোটেলটা একটা হেরিটেজ হোটেল। এর লিফটায় একসঙ্গে দুজন ওঠা যায় কি যায় না। কেচি গেট। মানে কলাপসিবল। নিজে টেনে গেট লাগাতে হয়। আর নিজের লাগেজ নিজেকেই টানতে হচ্ছে। একই লিফটে উঠলাম আমরা দুজন।

আমি বললাম, ‘আমি কিন্তু লিফট ভয় পাই।’

নাতাশা বললেন, ‘ওহ, মনে পড়েছে, আমরা একটা লিফটে আটকে পড়েছিলাম।’

আমাদের রুম পাশাপাশি। নাতাশা তাঁর ঘরে ঢুকলেন। আমি আমার ঘরে। দুপুরে একসঙ্গে খেতে যাব। এক ঘণ্টা পরে আমরা নিচে নামব…

আমার রুমের দরজায় নক।

‘কামিং…’আমি বললাম।

‘আমার ঘরে একটা মাকড়সা…আমি ভয়ে মারা যাচ্ছি…মাকড়সাটা একটু…’

‘আচ্ছা আমি আসছি…’

এর গায়ের এই বুনো গন্ধই আমাকে পাগল করে ফেলবে!

তিনি বললেন, ‘আমি আর ওই রুমে যাব না। আমি এই রুমেই রাত কাটাব।’

আমি বললাম, ‘তা কী করে হয়।’

বললাম কারণ, এই ঘরে বিছানায় একটা ছেঁড়া কাঁথা আছে। আমি সেটা সুটকেসে ভরে নিয়ে এসেছি। এই কাঁথায় আমার মায়ের শাড়ি আছে। আর ওই ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি যে স্বপ্ন বুনে চলেছি…এই মেয়েটি ঘরে ঢুকলেই যদি আমার স্বপ্নটা ভেঙেচুরে যায়!