শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি হাজার পঁচিশেক বেতনের চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯
news-image

আগামী অংশের পর

‘আমি আর্কিয়োলজি। জাহাঙ্গীরনগর। এরা তো বোধ হয় একজন নেবে।’ তিনি বললেন।

আমি বললাম, ‘তাহলে আপনাকে নেবে। ইউএন জবের পলিসি হলো নারীদের অগ্রাধিকার।’

‘না না। এমন কোনো কথা নেই। এদের কাজে প্রচুর ঢাকার বাইরে থাকতে হবে। কাজেই ছেলেদের এরা পছন্দ করতে পারে।’

আমার ইন্টারভিউ খারাপ হয়নি। সাইফুরসে স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করছি। ইন্টারনেটে রোজ এক ঘণ্টা ইংরেজি শেখার কোর্স করি নিজে নিজে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। মেক্সিকোর রাজধানীর নাম কী, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত জাতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি। একজন দেশি, একজন বিদেশি ছিলেন। দুজনেই পুরুষ। আমি কোথায় পড়েছি, কী পড়েছি, কী নিয়ে আগ্রহ—এসব বিষয়ে তাঁরা গল্প করলেন।

তাঁরা বললেন, ‘আপনার সঙ্গে যে ভদ্রমহিলা এসেছেন, তাঁকে কি একটু অনুগ্রহ করে আসতে বলতে পারবেন? আপনার কাজ শেষ। আপনি যেতে পারেন।’

আমি বাইরে এলাম। আমার ফুরফুরে লাগছে। ওয়েটিং রুমে এসে বললাম, ‘নাতাশা, আপনার কল। ওই যে দুই নম্বর দরজাটা, ওইটায় যেতে হবে।’

আমি বেরিয়ে এলাম। লিফটের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দরজা খুলল। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে দেখতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাওয়ার জন্য জি চাপলাম আমি।

রাত্রিবেলা নিজের ঘরে বসে আবার ইংরেজি শেখার প্র্যাকটিস করছি মোবাইল ফোনে ইউটিউবে। কিন্তু বারবার মনে পড়ছে নাতাশা হাবিবের মুখখানি। তিনি অন্ধকারে আমাকে খামচে ধরেছিলেন।

অন্ধকারে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতার ভেতরে শুয়ে নানা কিছু ভাবি। আকাশকুসুম চয়ন করি। আমার গায়ে ছেঁড়া কাঁথা। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি লাখ টাকা দামি স্বপ্ন রচনা করে যাই।

আমাদের দুজনেরই জব হয়ে গেছে। একই অফিসে চাকরি করি আমরা। দুপুরে একই ক্যানটিনে বসে খাই। নাতাশা ছোট্ট টিফিন বক্সে রান্না করা খাবার আনেন। আমার প্লেটে হলুদ খিচুড়ি আর সাদা ডিম তুলে দেন। আমি তাঁর চাপাকলির মতো আঙুলের দিকে তাকাই। তিনি ডান হাতের কনিষ্ঠায় লেগে থাকা একটা হলুদ ভাত নিজের লাল জিব বের করে চেটে নেন। তাঁর ঘামের গন্ধে টেবিলটার আশপাশ বুঁদ হয়ে থাকে।

রিগ্রেট লেটার আসে। ই–মেইলে। আমার ওই চাকরি হয়নি। আমি দমে যাই। মরমে মরে যাই। এই চাকরি হলে ভালো হতো। অবশ্য শুধু আমার হলে হতো না। নাতাশারও হতে হতো।

আমি ফেসবুকে নাতাশা হাবিব সার্চ দিই। তিনজনকে পাই। যাঁকে খুঁজছি, তাঁকেও পাওয়া যায়। রাতের বেলা বসে বসে মোবাইল ফোনে নাতাশার ছবি দেখি।

দুদিন পরে নাতাশা পোস্ট দেন ইউনেসকোর প্রজেক্টে তিনি যোগ দিয়েছেন।

একসময় নাতাশাকে আমি ভুলে যাই। টিউশনি, মেসের বাজার, চাকরির ইন্টারভিউয়ের চক্করে দিন কাটে। ছেঁড়া কাঁথাটা ভালোভাবে জড়িয়ে রাখি। এই কাঁথায় আমার মায়ের শাড়ি আছে। এটাতে আমি মাকে পাই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি। ছাত্র পড়াই, পরীক্ষা নিই, ক্লাবে যাই, শিক্ষক পলিটিকস করি। কিন্তু বেশি করে যা করি তা হলো, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপের খবর সংগ্রহ।

দিন চলে যায়। গোবিন্দগঞ্জ থেকে মা ডেকে পাঠান। ‘বাবা, আয় বাড়িতে একবার। তোর জন্য মেয়ে খুঁজছি। কেমন মেয়ে চাস? বল।’

আমি বলি, ‘মা, আমি এখন বিয়ে করব না। আমি আগে পিএইচডি করব। তারপর…’

নাতাশাকে আবার খুঁজি ফেসবুকে।

পেয়ে যাই। নাতাশা লিখেছেন, ‘আমার আম্মুসোনার আজকে বার্থডে। সারা দিন মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়েছি।’ একটা বছর দুয়েকের বাচ্চার সঙ্গে হুটোপুটি লুটোপুটির ছবি।

মাকে ফোন দিই। বলি, ‘মা, পাত্রী দেখো। পাত্রী শিক্ষিত হতে হবে মা।’

মা বলেন, ‘শিক্ষিত, সুন্দরী আর মার্জিত। আমার রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলে।’

আমি হাসি, ‘মা, রাজপুত্র তুমি কোথায় দেখেছ যে বলছ তোমার ছেলে দেখতে রাজপুত্রের মতো?’

বাকি অংশ মঙ্গলবার