শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি হাজার পঁচিশেক বেতনের চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৯
news-image

দুই ইঞ্চি হিলের সাদা রঙের স্যান্ডেল পরে তিনি হাঁটছেন। ফাঁকা করিডরে শব্দ উঠছে খটখট আর দূরের সাদা দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। এত সুন্দরও হয় একজন মানুষ! হতে পারে! আমার প্রাণের পরে চলে যাচ্ছেন তিনি।

আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। আমার নাম শহীদুর রহমান তাপস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছি। ঢাকা শহরে থাকি কলাবাগান এলাকায়, একটা বাসায় তিনজন ব্যাচেলর। দুটো টিউশনি করি। মেসে যে চৌকিটাতে আমি ঘুমাই, সেটা আজিমপুর থেকে কিনেছি, আট শ টাকায়। আমার কাঁথাটায় মায়ের শাড়ি আছে। কিছুটা ছেঁড়া। অঘ্রানের শীতে সেটা গায়ে জড়িয়ে থাকি। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি হাজার পঁচিশেক বেতনের একটা চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি।

আজ এসেছি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট প্রজেক্টের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নেওয়া হবে। এই ১৪ তলা ভবনের ১২ তলায় ১২০৯ নম্বর কক্ষে যেতে হবে আমাকে।

আমার গায়ে সাদা শার্ট। এটা আমার নয়। পাশের রুমের নেহালের। ও শার্টটা ঢাকা কলেজের উল্টো দিক থেকে কিনেছে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। আমি আজকের জন্য শার্টটা ধার নিয়ে এসেছি। আমার গলায় একটা টাইও ঝুলছে। এটা আবার আবুল কাশেমের। সে আমাদের আরেকজন মেসমেট। আবুল কাশেম একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের চাকরি করে। তাকে নিয়মিত টাই পরতে হয়। আমার গলায় টাইয়ের নট সে বেঁধে দিয়েছে।

আমি টেম্পো থেকে নেমে খানিকটা পথ হেঁটে আগারগাঁওয়ের এই ভবনে এসেছি। বাইরে তীব্র রোদ। যদিও আসন্ন শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে উত্তুরে বাতাস বইছে বাইরে, তবু আমার কপালে ঘাম। শার্টটা পিঠের কাছে চেপে বসছে।

দুটো সিঁড়ি ভেঙে এই বহুতল ভবনের নিচতলায় আসতেই একটা শীতল ছায়া আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখি সাদা শাড়ি পরা এক অপ্সরী দুই ইঞ্চি হিলের সাদা স্যান্ডেল পরে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন।

‘দারুণ সুন্দর কিছু দেখলে আমার একটু একটু কান্না আসে’—সুনীলের কবিতাটা আমি আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমমেটকে দিবস–রাত্রি বিরামহীনভাবে আবৃত্তি করতে শুনেছিলাম। তখন খুব বিরক্ত লাগত। এখন কবিতার লাইনটাই আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার কান্না পাচ্ছে, গোপনে।

আমি অবশ্য এই নারীর মুখ এখনো দেখিনি। এখনো তাঁরে চোখে দেখিনি, শুধু স্যান্ডেলের খটখট আওয়াজ শুনেছি।

তিনি লিফটের সামনে দাঁড়ালেন। আমিও।

লিফট জিনিসটা আমি ভয় পাই। আমাদের গোবিন্দগঞ্জের কোথাও কোনো লিফট ছিল না। ওখানেই স্কুল-কলেজ সেরে আমি রাজশাহী যাই। রাজশাহীতে দু-চারটা ভবনে লিফট ব্যবহার করতে হতো, ভয়ে পারতপক্ষে আমি সেসব ভবনেও সিঁড়ি ব্যবহার করতাম।

আমার সামনে তিনি। তাঁর পেছনে আমি। পারফিউমের গন্ধে আমার সমস্ত অস্তিত্ব আচ্ছন্ন হয়ে আসছে।

লিফটের দরজা খুলে গেল।

এই মেয়ের সঙ্গে আমাকে এই লিফটে উঠতে হবে। ত্রিভুবনে আর কেউ নেই। শুধু তিনি আর আমি।

লিফটের ভেতরে আয়না। আয়নায় আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি। এ যে সোনালি বেন্দ্রে! আমি হিন্দি ছবি দেখি না। কিন্তু সোনালি বেন্দ্রের খবর আমি রাখি। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তে তিনি এসেছিলেন। তখন আমি ক্লাস এইট–নাইনে পড়ি। যতক্ষণ ওই অনুষ্ঠান হচ্ছিল, সারাটিক্ষণ সোনালি বেন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সোনালি যখন হাসছিলেন, প্রতিবার আমার হৃৎস্পন্দন একবার করে থেমে যাচ্ছিল। সোনালির ক্যানসার হয়েছে, নিউইয়র্কে চিকিৎসা নিয়ে তিনি ভারতে ফিরে এসেছেন, এসব খবর আমি রাখি। চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসা যুবকদের দেশ-বিদেশের কত খবরই তো রাখতে হয়।

আমার সামনে একজন অল্প বয়সী সোনালি বেন্দ্রে। তাঁর শাড়ির রং সাদা। সাদা শাড়িতে রুপালি পাড়। ইস্তিরি করা নিপাট শাড়ির আঁচল। চুল বেণি করা। কপালের একপাশে সিঁথি। তাঁর শুকচঞ্চু নাসার ওপরে দুই টানা ভুরুর মাঝে একটা সাদা টিপ। উফ্। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে পড়ে নারীদের মাত্র একটা উপমা আমি জানি। মেয়েটা দেখতে পরির মতো। আর চোখ দুটো তাঁর ভীষণ মায়াকাড়া।

আমরা একই লিফটে উঠেছি। তিনি বিড়বিড় করলেন, ‘টুয়েলভ।’

আমিও বিড়বিড় করলাম, ‘আমিও টুয়েলভ।’

লিফটের দরজা বন্ধ হলো। এইবার পারফিউমের সঙ্গে খানিকটা ঘামের গন্ধও পাচ্ছি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। আমার নারীবর্জিত পৃথিবীতে এই রকম অপরূপার ঘামের গন্ধও যে ফুসফুস ভরে নেওয়ার মতো, এই কথা তো কাউকে বলাও যায় না।

লিফট উঠছে। দুই, তিন, চার…

একটা ছয় ফুট বাই চার ফুট পরিসরে আমার সঙ্গে একজন পরিমানবী। তাঁর গায়ে নাম না–জানা সুগন্ধি আর রুপালি দেহে সোনালি ঘামের অনির্বচনীয় গন্ধ।

ধপাস। একটা ঝাঁকুনি। লিফট অন্ধকার হয়ে এল। হাত দুয়েক নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল লিফট। আমি একটা আওয়াজ শুনলাম, আউচ, আর তিনি সোজা এসে দু-হাতে আমার দু-বাহু খামচে ধরলেন।

ঠিক আলিঙ্গন নয়। কনুইয়ের ওপরে আমার দুই হাতে তাঁর খামচিটা খানিকক্ষণ রইল।

আমার নিজেরই ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া।

লিফট অন্ধকার হয়েই আছে। বুক ধকধক করে কাঁপছে আমার। তিনি বললেন, ‘মা গো! আমি এই জন্যই লিফট খুব ভয় পাই!’

আমি বললাম, ‘আমিও লিফট খুব ভয় পাই।’

‘এখন কী হবে?’

আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই কারেন্ট গেছে। আসবে। জেনারেটর চলবে নিশ্চয়ই।’

পকেটের মোবাইল ফোন হাতে নিলাম আমি। মোবাইল সেটের টর্চ লাইট জ্বালালাম। অন্ধকার বেশি ভয়ের ব্যাপার। আলো তবু সান্ত্বনাদায়ক।

একটু পরে আলো জ্বলে উঠল।

তিনি আকুল হয়ে আছেন। আমিও। আমাকে খামচিমুক্ত করেছেন আগেই। আমি লিফটের নবে অ্যালার্মের ছবি খুঁজতে লাগলাম।

একটু পরে ভেতরের লেখাগুলো জ্বলে উঠল। তারপর ফের চলতে শুরু করল লিফট। টুয়েলভে এসে লিফট থামল। আমরা দুজনেই লিফট থেকে নামলাম। এদিক-ওদিক তাকালাম। তারপর সাইন দেখে এগিয়ে গেলাম। গেটে সার্চ করা হলো। স্বাক্ষর করতে হলো। ভিজিটর কার্ড গলায় ঝুলিয়ে আমরা ভেতরে এগোতে লাগলাম। পুরো অফিসটাই খুব নির্জন। অল্পসংখ্যক লোক বোধ হয় কাজ করে। আমাদের একটা কাচঘেরা ঘরে সোফায় বসতে বলা হলো।

দুজন বসে আছি।

তিনিই মুখ খুললেন। বললেন, ‘আমার নাম নাতাশা। নাতাশা হাবিব।’

‘আমার নাম শহীদুর রহমান তাপস।’

‘আমি এসেছি জবের ইন্টারভিউ দিতে।’

‘আমিও।’

‘আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড কী? কোন সাবজেক্ট?’

‘হিস্ট্রি। আপনি?’

বাকি অংশ মঙ্গলবার