শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দীপাবলির ছুটি ঘুরে আসুন মরুর দেশে

News Sundarban.com :
অক্টোবর ২৫, ২০১৮
news-image

সামনেই দীপাবলির ছুটি। পুজোয় যাঁদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি, তাঁরা হয়ত অনেকেই প্ল্যান করে রেখেছেন এই সময়টা কোথাও ঘুরে আসার। আর যাঁরা এখনও ভাবেননি, তাঁরাও নিশ্চয় ভাবছেন, কাজের ব্যস্ততার মাঝে এই ছুটিতে কোথাও ঘুরে এলে ভালো হয়। কিন্তু ভাবলেই তো হয় না। কোথায় যাবেন সেই পরিকল্পনা নিশ্চয়ই করছেন। চলুন দেখে নেওয়া যাক এই কটা দিন কোথায় গিয়ে কাজের ব্যস্ততা ভুলে মনটাকে শুধুই ছুটির মেজাতে ভরিয়ে তোলা যায়।

জয়সলমীরঃ সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা ছবিতে মুকুলের চোখেই প্রথম দেখা জয়সলমেরের সোনার কেল্লা। সত্যিই কি ওই বিশাল দুর্গ সোনা দিয়ে তৈরি? তবে চাক্ষুষ না দেখ্লে আপনিও জীবনের এক আশ্চর্য্য দর্শনীয় স্থান না দেখা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন। কয়েকশ বছর আগের তৈরি হলুদ পাথরের বিশাল দুর্গ। দেখে মনে হবে যেন সোনা দিয়ে গড়া। প্রথম এই দুর্গের দেখা পেয়েছিলাম ছোটোবেলায়। ১১৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই পাথরের দুর্গ বানিয়েছিলেন রাজপুত রাজা রাওয়াল জয়সল। নিজের নামেই রেখেছিলেন দুর্গর নাম, জয়সলমের দুর্গ। সেই দুর্গ এখনও থর মরূভূমির বুকে রাজপুতানা ঠাঁটবাট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেমন এই দুর্গের ভিতরটা? কী আছে সোনার কেল্লায়? সেসব দেখতে সপ্তাহখানেকের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন জয়সলমের। আর যদি সদ্য সাতপাকে বাঁধা পড়ে থাকেন, তবে সঙ্গীর মনের গভীরের খোঁজ নিন মরূভূমির মরীচিকাতেই।

যারা ঘুরতে ভালোবাসেন, কিংবা ফটো প্রেমীরা, হানিমুনটা একটু রাজার হালে কাটাতে চাইলে জয়সলমের থেকে ভালো জায়গা আর কিছু হতে পারে না। তাই দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে রওনা দিন রাজস্থানের পথে। রাজ্যের অন্যতম বড় শহর জয়সলমের। একদিকে ধূ ধূ বালির প্রান্তর। তারমধ্যে হলুদ পাথরে তৈরি জয়সলমের দুর্গ।
কীভাবে যাবেনঃ যেকোনও বড় শহরের সঙ্গেই রেলপথে যোগাযোগ রয়েছে জয়সলমেরের। আর আকাশপথে যেতে হলে সবথেকে কাছের এয়ারপোর্ট যোধপুর। সেখান থেকে গোল্ডেন সিটিতে যেতে গাড়ি ভাড়া করে নিন।

যেখানে থাকবেন ঃ এখানে নানারকম দাম ও মানের হোটেল আছে। কেল্লার ভেতরেও হোটেল পাবেন।রাজস্থান ট্যুরিজমের হোটেলটির নাম মুসল। এখানে উঠলে ভালো হয়। তারকাখচিত হোটেলে উঠতে হলে নারায়ণ নিবাস প্যালেস, হিমায়ত গড় প্যালেস, নয়তো হেরিটেজ টনে উঠুন। ভালো পরিবেশে থাকতে চাইলে হোটেল সানরে, রামা গেস্ট হাউস, ফোর্টভিউ হোটেল, স্বস্তিকা হোটেল, দীপক রেস্ট হাউস, হোটেল প্যারাডাইস, আনন্দবিলাস হোটেল, গোল্ডেন রেস্ট হাউস নয়তো হোটেল জয়সল ক্যাসলে উঠুন।
কী কী দেখ্বেঃ জয়সলমেরে একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে চাইলে পুরো সময়টা হোটেলে না কাটিয়ে এক-দু’দিন কাটাতে পারে টেন্টে। এখানকার তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়। রাতের বেলা তাঁবুর মালিকরা সেখানে নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। রাজস্থানী ফোক নৃত্য থেকে শুরু করে স্থানীয় গায়কদের গানের আসর থাকে। সেসব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে পারবেন। জয়সলমীরে প্রতিবছর ডেজার্ট ফেস্টিভ্যাল হয়। সে সময় সেখানে গেলে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন। যেমন- উটের নাচ, উটের সাজের প্রতিযোগিতা, গোঁফ ও পাগড়ির প্রতিযোগিতা বিবিধ। রাজস্থানের শিল্পপণ্য কেনাকাটারও সবচেয়ে বড় সুযোগ পাওয়া যায় ‘মরু উৎসব’ উপলক্ষে।
জয়সলমের মানেই প্রধান দ্রষ্টব্য অবশ্যই দুর্গ। যাকে বলে সোনার কেল্লা। যা ছোটোবেলায় আমাদের মকুলের চোখ দিয়ে দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ২০১৩ সালে এই দুর্গকে হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে UNESCO। দুর্গের ভিতরে রয়েছে অনেক মন্দির। কয়েকশ বছরের পুরোনো স্থাপত্যের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে এই দুর্গে। এছাড়া জয়সলমেরের দেখার জায়গা রয়েছে অনেক। মরুভূমির চতুর্দিকে ছড়ানো রয়েছে ইতিহাস। আর সেসব ইতিহাস যদি একজায়গায় দেখতে চান তবে ঘুরে আসতে পারেন জয়সলমের গভর্নমেন্ট মিউজ়িয়াম। সময় করে অবশ্যই ঘুরে আসবেন জয়সলমেরের হাভেলিগুলো। জয়সলমেরের সবথেকে বড় হাভেলি হল পতোঁ কি হাভেলি। আরও যে দুটি জিনিস মিস করবেন না, তা হল আকাল উড ফসিল পার্ক, ডেজ়ার্ট ন্যাশনাল পার্ক। এছাড়া সঙ্গীর হাত ধরে টুকটুক করে ঘুরে দেখে নিন রাজপুতদের গোটা শহরটাই। মরুভূমির বুকে উটের পিঠে চড়তে ভুলবেন না। এখানকার অন্যতম রোমাঞ্চ ক্যামেল সাফারি।

জয়পুরঃ পিঙ্ক সিটি বা গোলাপি শহর নামে সুপরিচিত রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। রাজস্থান ভারতের পর্যটন স্থানগুলির একটিতে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের তৃতীয় কোণ হিসেবে। শহরের তিনদিকে রয়েছে পাহাড়। এখানে দেখা যায় দূর্গ এবং মিনার। পুরো শহর যেন গোলাপি রংয়ে একাকার হয়ে আছে। রাজা দ্বিতীয় রামসিং গোলাপি রং খুব ভালবাসতেন বলেই প্রতিটি বাড়ি এবং দোকানে গোলাপি রং করার আদেশ দেন। জয়পুর শহর গড়ে তুলে রাজা জয়সিং। তার নামানুসারে এই শহরের নাম জয়পুর করা হয়। জয়পুরের অন্যতম আকর্ষণ হল হাওয়া মহল। বিচিত্র শিল্প নৈপুণ্যে ভরা এই প্রসাদটি পাঁচতলা বিশিষ্ট। প্রতাপসিং ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। স্যার এডুইন এনরোল্ড হাওয়া মহলের সৌন্দর্য্য দেখে বলেছিলেন ‘আলাদিনের আশ্চর্য্য প্রদীপও এত সুন্দর মহল বানাতে পারতো না।’শোনা যায় হাওয়া মহলে বসেই রানীরা উৎসব দেখতেন। ভবনটির পেছনে রয়েছে ৩৬০টি জানালা আর অভ্যন্তরে রয়েছে স্নান কুণ্ড। জয়পুরে দেখার মতো আছে গোবিন্দজীর মন্দির, জলমহল, অম্বর প্যালেস, কালী মন্দির, জয়মনি মন্দির, দেওয়ান-ই-আজম, দেওয়ান-ই-খাস, সুখমন্দীর, সিটি প্যালেস মিউজিয়াম, নাহারগড় দুর্গ প্রভৃতি। প্রাকৃতিক হ্রদের মধ্যে অবস্থিত জলমহলটি সত্যি দেখার মতো। শহর থেকে ৭ কিমি দূরে অবস্থিত। এক সময় রাজাদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশের স্থান ছিল এটি। হ্রদটির নাম মানসাগর। এর একটু দূরেই রয়েছে মানসিং দুর্গ। সপ্তদশ শতকে নির্মিত এই দুর্গের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য রয়েছে কয়েক মাইল দীর্ঘ চওড়া পরিখা। এই জায়গার নাম অম্বর যা পূর্বে রাজস্থানের রাজধানী ছিল এবং জয়পুর থেকে ১১ কিমি দূরে অবস্থিত। মানসিংস দুর্গের সিঁড়ি দিয়েই ঢুকে দেখা যাবে কালীমন্দির। অম্বর রাজপ্রাসাদের কাছেই রয়েছে একটি মসজিদ। এটির নাম অম্বর মসজিদ। সম্রাট আকবর এটি নির্মাণ করেন।সুন্দরগড় যা পাহাড়ে অবস্থিত এবং দেখতে একেবারে বাঘের মতো। সিটি প্যালেস এবং মুবারকমহল শ্বেতপাথরে তৈরি। ভেতরে ও বাইরে অসাধারণ কারুকার্যে ভরা। সিটি প্যালেসের পিছনেই রয়েছে জন্তর-মন্তর মানমন্দির। যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মান মন্দির। জয়সিং নির্মিত এই মন্দির প্রমাণ করে জ্যোতির্বিদ্যায় তার অসাধারণ ক্ষমতা। জয়সিং প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি মানমন্দিরের মাঝে জন্তর-মন্তরই শ্রেষ্ঠ। উত্তর-পূর্বে সাজানো বাগান এবং এই বাগানে পাশেই রয়েছে জয়সিংসহ রাজপরিবারে অন্যান্য সদস্যের সমাধি। লালচে গোলাপী সকল স্থাপনায় ঠাসা জয়পুর শহর। এই শহরে এলে পরে আপনি ভেবে পাবেন না, কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন। জয়পুর থেকে ২ ঘণ্টা লাগে গাড়ীতে আজমির শরীফ যেতে। জয়পুর থেকে পুষ্করও খুব কাছে। পুষ্কর এর মরুভূমিতে উটে চড়তে পারেন। যা যা দেখ্বেন, আম্বার ফোর্ট এন্ড প্যালেস, হাওয়া মহল, জল মহল, নাহারগড় ফোর্ট, ফোর্ট অফ জয়পুর, জয়গড় ফোর্ট, রাজস্থান ডেজার্ট সাফারি, রন্থোমবর জাতীয় উদ্যান, রামবাগ প্যালেস, সিটি প্যালেস, জন্তর মন্তর, এলবার্ট হল মিউজিয়াম, গালতাজি (বানর) মন্দির, বিড়লা মন্দির, এলিফ্যান্ট সাফারী, পান্না মিনা’র কুণ্ড, গেটওয়ে অফ গনেশ পাল।


বিকানীর: বিকানীরকে বলা হয় মরুভূমির সূচনা-অংশের শহর। সবুজের সমারোহ খুঁজে পাবেন না। যেদিকে যাবেন দেখবেন মরুভূমি। বিকানীর শহরের পত্তন হয় মধ্যযুগে সেই ১৪৮৮ সালে। এ শহরের প্রতিষ্ঠাতা রাজপুত শাসক রাও বিকাজী। তার নামেই এ শহরের নাম হয়েছে বিকানীর। বিকানীর প্রধান আকর্ষণ জনাগড় কেল্লা। এর ভেতরে রয়েছে প্রাসাদ। এখানে দেখবেন চন্দ্রমহল, সূর্যমহল, শিসমহল, ফুলমহল, করনমহল, রানিমহল, ছত্রমহল, বাদলমহল প্রভৃতি।
প্রত্যেকটি শহরের মাঝখান থেকে শুরু করে ছাদের সিলিং পর্যন্ত অনবদ্যভাবে চিত্রিত ও কারুকার্যখচিত। রঙের উৎসব যেন প্রত্যেকটি মহলে। দুর্গের সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখার মতো।
মিউজিয়ামেও যেতে পারেন। নাম গঙ্গা গোল্ডের মিউজিয়াম। এখানে দেখবেন হরপ্পা সভ্যতা, গুপ্ত ও কৃষাণ যুগের নানা মহামূল্যবান নিদর্শন। কেল্লা দেখা শেষ করে এবারে যান লালগড় প্যালেসে। বর্তমানে লালগড় প্যালেস বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে পাহাড় খোদাই করে তৈরি জালি ও জাফরির কাজ অনবদ্য। বারবার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে। দেবীকুণ্ড আর সুখসাগর হ্রদ দেখার জন্য আসুন এবার।


এসব কীর্তি দেখতে যেখানেই যান না কেন, অটো ভাড়া করে যেতে হবে। ক্যানেল ব্রিডিং ফার্ম বিকানীর থেকে ৯০ কিমি দূরে। এখানে গেলে দেখতে পাবেন শত শত উট। উটের পিঠে চেপে মরুর মাঝে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসতে পারেন। একই সুযোগে দেখে আসুন গজনের প্রাসাদ ও অভয়ারণ্য। গজনের প্রাসাদের দেয়াল, মেঝে এবং সিলিং সুন্দরভাবে চিত্রিত। প্রাসাদের কাছেই অভয়ারণ্য। এখানে দেখবেন মরুভূমির জীবজন্তু।