বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আপনার বাচ্চা কী অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে?

News Sundarban.com :
জুলাই ১৮, ২০১৮
news-image

বাবা-মার ক্ঠোর পরিশ্রম, পরিকল্পনা, উদ্যোগ, এত স্বপ্ন-এর বিরাট অংশ জুড়েই আছে শিশু। বাবা মায়ের পুরো সময়টাই কাটে শিশুকে নিয়ে। এত ভালোবাসা, এত সাধনার ধন শিশু, তাকে বড় করে তোলা কিন্তু সহজ নয়। বড়রা শিশুদের কাছে যেমনটা প্রত্যাশা করেন, শিশু কিন্তু অনেক সময় তেমনটা করতে আগ্রহী থাকেনা। তখন অভিভাবকেরা দুঃখিত হন, বিরক্ত হন, হন আশাহত। কেন হয় এমনটা?
জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে শিশুরা বড়দের অবাধ্য হয়। এটা বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ। এর মাধ্যমে শিশু বড়দের প্রত্যাশা ও আগ্রহের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠে। সে তার নিজস্ব সত্বা সম্পর্কে ধারণা পায়। সে প্রশ্ন করে, কেন একটি কাজ তাকে করতেই হবে তা জানতে চায়, এই অভিজ্ঞতাগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। বেশ কিছু বিষয় সে বড়দের থেকেও নেয়। সাথে সাথে গড়ে উঠে তার নিজস্ব সত্বা। সে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের এবং একধরণের স্বাধীনতার স্বাদ পায়। যখনই তারা তাদের অভিভাবকদের সাথে কোন দ্বন্দ্ধে জড়ায়, তখনই তারা তাদের অভিভাবকদের নিয়ম-নীতির সীমা এবং তাদের নিজেদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের সীমা সম্পর্কে ধারণা পায়। একটা মাত্রার মধ্যে শিশুর অবাধ্যতা তাই স্বাস্থ্যকর। শিশু যদি বাবা-মায়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে বিনা প্রশ্নে মেনে নিত তবে সে হয়ে উঠতো বাবা মায়ের ব্যক্তিত্বের কপি যা মোটেই কাম্য নয়। মানব প্রজাতির বিকাশে বৈচিত্রের কোন বিকল্প নেই। ব্যক্তিত্বের কার্বণ কপি দরকার নেই। দরকার নতুন ধরণের মানুষ।

মাঝে মাঝে এই ধরণের অবাধ্যতা অল্পতেই মিটে যেতে পারে। আবার কখনো কখনো এটা তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠে। তখনই এটা সমস্যায় পরিণত হয়।

যে কারণে শিশু অবাধ্য হয়ঃ

কোন কোন বাচ্চা ও কোন কোন অভিভাবকদের মেজাজ জন্মগতভাবেই বেশ চড়া থাকে, তারা বেশ অস্থির, হটকারী ও অল্পতেই বিরক্ত হয়। শিশু তার স্বাধীনতা প্রকাশের অংশ হিসাবেও বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারে।
একক অভিভাবক অথবা যেসব বাবা-মা চাপের মধ্যে আছেন তাদের আচরণ বাচ্চাদের মধ্যে অনেক সময় অনিশ্চতয়তা, নিরাপত্তাহীনতা বা রাগ তৈরী করে যার ফলে তারা অবাধ্য হতে শুরু করে। অন্যদের অবাধ্যতা দেখেও শিশু অবাধ্যতা শিখতে পারে।
বাবা-মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক যদি তেমন ভাল না হয়, বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে যদি তারা তাকে যথেষ্ট গুণগত সময় দিতে ব্যর্থ হন, তখন শিশুর মধ্যে তাদের প্রতি অবাধ্যতা দেখা যায়।
অনেক সময় অবাধ্যতা করে শিশু সুবিধা পায়। ফলে সে অবাধ্যতাই শিখে। এমনও হতে পারে যে, সাধারণভাবে সে তার সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেনা। কিন্তু আচরণ খারাপ করলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তার চাহিদা বড়রা মেনে নেন। শিশু যখন ভাল আচরণ করে তখন অভিভাবকেরা তার প্রতি মনোযোগী হননা। কিন্তু খারাপ আচরণ করলে তারা তার প্রতি নেতিবাচক মনোযোগ দেন। বকাঝকা করেন। সে এই মনোযোগ পছন্দ করে। ফলে সে আরো বেশী করে অবাধ্য আচরণ করে।
কিছু মানসিক রোগ থাকলে শিশুর মধ্যে অবাধ্যতা বেশী দেখা যায়। যেমন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুরা তাদের বোঝার অক্ষমতার জন্য অবাধ্যতা বেশী করে। অটিজম আছে এমন শিশুরা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। তাদের গুরুতর যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন সমস্যা থাকে। ফলে তারা বড়দের নির্দেশনা বুঝতে পারে, যার ফলে তারা তা মানতেও পারেনা। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅরডার আছে এমন শিশুরা মনোযোগের সমস্যার কারণে আচরণ সমস্যা বেশী করে। এছাড়া সাইকোটিক রোগ, যেমন, স্কিজোফ্রেনিয়া বা এধরণের অসুখ হলে অসুখের বৈশিষ্ট্যের কারণেই এরা বেশ অবাধ্যতা করে। শিশুদের মধ্যে বিষন্নতা ও উত্কণ্ঠা রোগ থাকলেও তাদের আচরণ খারাপ হয়ে থাকে।

যখন আপনার শিশু ক্রমাগত অবাধ্যতা করে তখন তার কারণ অনুসন্ধান করুন। এই কারণগুলো দূর করার ব্যবস্থা করুন।

শিশুর অবাধ্যতা দূর করার জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো নিন ।
আপনার পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে কতটা সন্মান করে তা দেখুন। যদি তারা একে অপরের সাথে অসৌজন্য করে তবে শিশুও তা শিখবে। শিশু সব আচরণই দেখে শিখে। পরিবারের সদস্যরা সৌজন্য বজায় রাখলে শিশুও সৌজন্য শিখবে।
বড়দের উচিত একে অপরের মূল্যবোধ, ধারণা, ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে সন্মান করা। তবে শিশুরাও এমনটা করতে শিখবে। বড়দের শিশুর জন্য রোল মডেল হয়ে উঠতে হবে। তাদেরকে তাদের বড়দের মান্য করতে হবে। নিজে খারাপ ব্যবহার করে শিশুর কাছে সৌজন্য আশা করাটা বৃথা।

পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন বাড়াতে হবে। মনোমালিন্য তৈরী হলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করতে হবে। পরিবারের সদস্যরা ভাষা ব্যবহারে সংযত হবেন। তারা কথা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করবেন। কোন কথার মানে দাঁড় না করিয়ে কি বলতে চান তা পরিষ্কার করে বলে ফেলবেন। অন্য সদস্যদের কোন কাজে তার অসুবিধা হলে তা মুখে বলবেন ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবেন। এই গণতান্ত্রিক পরিবেশ শিশুকে তার মত প্রকাশ করতে সাহায্য করে। তার সাথে দ্ব্বিমত থাকলে অভিভাবকেরা তা বুঝিয়ে বলবেন। ফলে শিশুর অবাধ্যতার প্রয়োজন পড়বেনা। শিশুর একটি অনুরোধ রাখতে না পারলে তার জন্য অন্য একটি বিকল্প প্রস্তাব দিলে ভাল হয়। যেমন, আপনার মেয়ে সন্তানটি একা বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যেতে চাইলো। আপনি রাজি হলেননা। আপনি হয়তো তাকে বলতে পারেন সে যদি অভিভাবকদের মধ্যে একজনকে সাথে নিয়ে যায় তবে আপনি তাকে অনুমতি দিবেন। ফলে সে ততটা অসন্তষ্ট হবেনা।

শিশু ভাল আচরণ করলে তাকে পুরষ্কৃত করুন; যেমন, আদর করুন, প্রশংসা করুন, পছন্দের জিনিস কিনে দিন। শিশুদের পছন্দমতো খাবার দেয়া, খেলনা কিনে দেয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, প্রশংসা, আদর এসবই পুরষ্কার হিসাবে কাজ করে। ভাল আচরণ পুরস্কৃত করলে এই ধরণের আচরণের সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে।

যতটা সম্ভব শিশুর খারাপ আচরণ উপেক্ষা করুন। কোন ধরণের মনোযোগ না পেলে খারাপ আচরণ কমে যাবে।

শিশু-কিশোররা হুমকি দিয়ে বা খারাপ আচরণ করে যাতে লাভবান না হয় তা নিশ্চিত করুন। যেমন, হুমকি দিলেও তার হুমকির কাছে নতি স্বীকার করে তার চাহিদা পূরণ করবেন না।
ছোট বেলা থেকেই শারীরিক ও দলীয় খেলায় শিশুকে উত্সাহিত করুন। শিশুর বিকাশে খেলার গুরুত্ব অনেক। বয়স উপযোগী খেলার ব্যবস্থা করুন। খেললে খারাপ আচরণ করার জন্য শিশু কম সময় পাবে।
বাবা-মা ও অভিভাবকেরা একমত হয়ে শিশুর উপর পারিবারিক শৃঙ্খলা আরোপ করবেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, শৃঙ্খলা সবার ক্ষেত্রেই যাতে সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়।
শিশু-কিশোরদের কথা গুরুত্বসহ শুনুন ও বিবেচনা করুন। যদি আপনি তাদের সাথে ভিন্নমত হন তবে তাদেরকে ভিন্নমতের কারণ ব্যাখ্যা করে বলুন। শিশুকে মারবেন না। শিশুকে ভয় দেখাবেন না। শিশু-কিশোরদের ভালবাসুন। দুষ্ট বাচ্চাদের বা সমস্যাপূর্ণ বাচ্চাদের স্নেহ-ভালোবাসা আরো বেশী প্রয়োজন।
এছাড়া শিশু বা অভিভাবকদের যদি রাগের সমস্যা থাকে বা কোন মানসিক সমস্যা থাকে তবে তার যথাযথ চিকিত্সা নিশ্চিত করতে হবে।
শিশুকে কিছু করতে বললে তা কার্যকরভাবে বলতে হবে। তবেই তার নির্দেশনা মেনে চলার সম্ভাবনা বাড়বে। শিশুকে কার্যকরভাবে নির্দেশনা দেবার কতগুলো নিয়ম আছে যা অনুসরণ করে আমরা শিশুর অবাধ্যতা কমাতে পারি।শিশুকে নির্দেশনা দেবার সময় ভদ্রভাবে সৌজন্যের সাথে দিতে হবে। এজন্য-একাজটি করে দাও প্লিজ-এভাবে বলা যায়। নির্দেশনা দেবার সময় চিত্কার করে বা খারাপ ভাষায় বলবেন না। তার কাছাকাছি গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে তাকে নির্দেশনা দিন। নিশ্চিত হোন যে, আপনার কথায় সে মনোযোগ দিয়েছে। সে যদি টিভি দেখতে থাকে বা খেলায় ব্যস্ত থাকে তবে সম্ভব হলে তার এই কাজটি একটি পর্যায় পর্যন্ত শেষ হতে দিন। এরপর টিভি বা খেলা বন্ধ করে তারপর নির্দেশনা দিন। আপনার নির্দেশনা সে বুঝেছে কিনা তা তার থেকে জেনে নিন। একেকবারে একেকটি করে নির্দেশনা দিন। জটিল নির্দেশনা হলে একবারে নির্দেশনা না দিয়ে ধাপে ধাপে

এটিকে কয়েকটি ভাগে ভেঙ্গে কয়েকবারে এই নির্দেশনাটি দিন। শিশু একেকটি নির্দেশনা মানলে ধাপের পরবর্তী নির্দেশনাগুলো দিন। নির্দেশনা দেবার সময় কতটুকু সময়ের মধ্যে এটি করতে হবে তাও পরিষ্কার করে বলে দিন।

যে শিশু বড়দের কোন নির্দেশনা মানতে চায়না তাকে নির্দেশনা দেবার সময় এটি মানতে উত্সাহিত করতে হেসে, পিঠ চাপড়ে বা কৌতুক করে নির্দেশনা দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

প্রত্যাশিত আচরণকে পুরষ্কৃত করলে এটি করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। শিশুর সাথে আলাপক্রমে পুরষ্কার ঠিক করা যেতে পারে। জটিল ধরণের নির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করার সাথে সাথে পর্যায়ক্রমিকভাবে পুরষ্কার দেয়া যায়। পুরষ্কারের সাহায্যে একঘেয়ে ও নিরানন্দ কাজও করিয়ে নেয়া যায়। পুরষ্কার তাত্ক্ষণিকভাবে দিলে ভাল হয়।

শিশুকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর আপনি আপনার কাজে যেতে পারেন। এরপরও তার কাজের ধারাবাহিকতার দিকে লক্ষ্য রাখুন। অনেক সময় শুরু করেও সে কাজ থামিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে তাকে আবার কাজটি শুরু করতে বলুন।
নির্দেশনা দেবার পর শিশু যদি বিভ্রান্ত বোধ করে নির্দেশনাটি এবং কেন এটি দেয়া হচ্ছে এই বিষয়টি শিশুকে সহজ ভাষায বুঝিয়ে বলুন। একবার বুঝিয়ে বলাই যথেষ্ট। এরপর প্রয়োজনে দৃঢ়তার সাথে নির্দেশনাটি পুনরাবৃত্তি করবেন। আর ব্যাখ্যা করবেন না।
শিশুকে একটি কাজ থেকে অন্য কাজে সরিয়ে নিতে হলে তাকে অন্ততঃ পাঁচ মিনিট আগে বলুন। তাকে মানসিক প্রস্তুতি নেবার সময় দিন। এরপরও দুই মিনিট আগে আরেকবার মনে করিয়ে দিন। এরপর তাকে সে যে কাজটি করছে তা থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কাজে লাগান।
কোন কোন শিশু অত্যন্ত বিদ্রোহী ধরণের হয়। এক্ষেত্রে বলুন যে আপনি এক-দুই-তিন গুণবেন। এরমধ্যে সে যদি নির্দেশনা না মানে তবে তাকে শাস্তি পেতে হবে। কি শাস্তি পেতে হবে তাও বলুন। অবশ্যই শারীরিক শাস্তি দেয়া চলবেনা। সে হয়তো টিভি দেখছিল। টিভিটি বন্ধ করে দেয়াই শাস্তি হতে পারে। সে যদি তিন গণনার পর নির্দেশনা মানেও তবুও তাকে শাস্তি পেতে হবে। কেননা সে সময়সীমার মধ্যে নির্দেশনা মানেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে শাস্তি হিসাবে শিশুর কোন একটি পছন্দের জিনিস, যেমন, খেলনা জব্দ করা যেতে পারে। এমনকি প্রয়োজনে বিরক্তিকর কোন পরিবেশে তাকে মিনিট দশেক আটক করে রাখা যেতে পারে। তবে শেষ দুটো শাস্তি বাধ্য না হলে প্রয়োগ না করাই ভাল। শাস্তি যদি দিতেই হয় তবে তা তাত্ক্ষণিকভাবে দিতে হবে।
শিশুকে নির্দেশনা কিভাবে দিবেন তা শিশুর বয়স, বুদ্ধিমত্তা, বা কোন প্রতিবন্ধীতা (শারীরিক বা মানসিক) আছে কিনা তার উপর নির্ভর করে। বোঝার ক্ষমতার অভাব থাকলে অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় একেকবারে একটি করে নির্দেশনা দিতে হবে।

শিশু প্রতিটি ক্ষেত্রে বড়দের সব আদেশ নির্দেশ মেনে চলবে এমনটা আশা করা যায়না। তার অবাধ্যতা একটা মাত্রার মধ্যে থাকলেই হলো। লক্ষ্য রাখুন আপনি শিশুর থেকে খুব বেশী প্রত্যাশা করছেন কিনা। শিশুর মধ্যে সাধারণ চঞ্চলতা থাকে। কিশোর-কিশোরীদের বিকাশের অংশই হচ্ছে বড়দের প্রতি একধরণের বিদ্রোহী মনোভাব। মনের মধ্যে তাদের