বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“খলসি” মধু সংগ্রহে মৌলেরা সুন্দরবনে

News Sundarban.com :
এপ্রিল ১৩, ২০১৮
news-image

নাওয়া-খাওয়া ভুলে দল বেঁধে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জঙ্গলে মধু সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত মৌলিরা(মধু সংগ্রহকারী)।হাতে সময় মাত্র একটি মাস এপ্রিল।নদীর স্রোতের মতো গড়িয়ে অতিবাহিত হয়ে চলেছে সময়। সেই অমূল্য সময় কে নষ্ট করতে রাজী নয় সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার মধুসংগ্রাহক মৌলেরা তাই মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত।মূলত মধুমাস এপ্রিল মাস।এই সময় হিমালয় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছিরা আসে।এই মৌমাছি চেহারায় বেশ বড়। প্রায় এক দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়।এই পাহাড়ী মৌমাছির নাম ডাঁশ(Rock Bee)।এরা লোকাল মাছি কিংবা মৌমাছিকে অনায়াসেই আক্রমণ করে মেরে ফেলে।“খলসি” গাছের ফুল ও এই সময় ফোটে। সেই ফুলথেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য কোটি কোটি মৌমাছির আগমন ঘটে হিমালয় থেকে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে। আবার সমগ্র পৃথিবী যত বাদাবন জঙ্গল আছে তার মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনের জঙ্গলে খলসি গাছ হয়। পৃথিবীর অন্যত্র কোন জঙ্গলে হয় না।এই খলসী ফুলের গন্ধ বড়ই মধুময়।সমগ্র সুন্দরবনের ১৯টি ব্লক।এরমধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় ১৩টি এবং উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় ৬ টি।অাবার বনবিভাগের নিয়ম অনুযায়ী ২২টি ব্লক(বন্যপ্রাণী দ্বীপ)এর ১১৫ টি কম্পর্টমেন্ট(ঘন জঙ্গল এলাকা) মধু পাওয়া যায়।চলতি মধুর সিজন এপ্রিল মাসে প্রায় ৭৫০ জন মৌলে সুন্দরবনের জঙ্গলে গিয়েছে মধু সংগ্রহের জন্য। খলসি ফুলের মধু অত্যন্ত সুস্বাদু হয় এবং অন্যান্য ফুলের মধু সামান্য হলেও তিতা হয়। বনদপ্তর আবার এই মধু মৌলেদের কাছে সংগৃহিত মধু কিনে নিয়ে শোধন করে “মৌবন” নামে বাজারে বিক্রি করে।
বিপদ সঙ্কুল প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে মধু(সুন্দরবনের তরল সোনা)সংগ্রহ অন্যতম প্রধান জীবিকা মৌলেদের। গ্রামবাসী,জেলে-মৌলেরা ৭-৮ জনের এক একটি দল পৃথক ভাবে জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে। এই কাজে যাওয়ার আগে গ্রামে সাড়ম্বরে “বনদেবী”(বনবিবি),দক্ষিণ রায়ে’রপূজা, “দুখে যাত্রার”র আয়োজন করে। দক্ষিণরায়ের ডেরা থেকে সুস্থ,অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার জন্য গৃহের মহিলারা উপবাস করে স্নান করে সুচিবস্ত্রে দেবীর কাছে কান্নাকাটির পর মানত করে হাতে পুরোহিতকে দিয়ে লাল সুতোর মাদুলী-তাবিজ-কবচ বাঁধিয়ে নেয়। জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা কিংবা বিদায় বেলায় চোখের জল ফেলা নিষিদ্ধ।সংসারের আপন প্রিয়জন জঙ্গল থেকে কবে বাড়ী ফিরবেন সেই অপেক্ষায় নদীর পাড়ে পথ চেয়ে বসে থাকেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।বাড়ীতে চলে শোকের ছায়া,পালিত হয় অশৌচ।বাড়ীতে একমাত্র দেবীর পূজার্চনা ছাড়া সমস্ত রকম আমোদ-প্রমোদ আনন্দ বন্ধ থাকে।এছাড়াও বাড়ী গৃহবধুরা শাঁখা,সিঁদুর পরা,কাপড় কাচা বন্ধ রাখেন। বাড়ীর প্রিয়জন মানুষটি বাড়ী ফিরলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয় আনন্দ উৎসব।হয় পূজার্চনা। এমনকি জাঁকজমক করে বাড়ী কিংবা বনের ভিতরে গিয়ে দেবীকে পূজা করা হয়।
অনেক মৌলে অাবার বাঘের মুখ বাঁধা মন্ত্র জানা গুনীণকে সাথে করে নিয়ে যান।বনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগে পাঁচ পীর(মানিক পীর,দরিয়া পীর,সত্য পীর,গোরাচাঁদ পীর,কাউর পীর) এর নামে “বদর বদর” ধ্বনি দিয়ে সকল দেব-দেবীর আশীর্বাদ নেন।
গভীর জঙ্গলে মধুর চাক কাটার সময় নদীতে স্নান করে ভিজে কাপড়ে কোন এক গাছের গোড়ায় গরাণ পাতার থালা তৈরী করে গুড়ের বাতাসা দিয়ে পূজা করেন।এরপর গুণীন জঙ্গল বেঁধে দেওয়ার পর শুরু হয় উড়ন্ত মৌমাছি গতি বিধি লক্ষ্য করে মৌচাক খোঁজা।আবার পরষ্পর সঙ্গীরা নিরাপদে আছে কি না তা জানান দিতে কিছুক্ষণ পর পর “ক—–ক——ক—–” ধ্বনি শব্দে নিজেদের খেয়াল রাখে।কোন প্রকার সাড়া-শব্দ না পাওয়া গেলেই ধরে নেওয়া হয় তাকে বাঘে নিয়ে গেছে কিংবা কোন বিপদে পড়েছে। বেগতিক বুঝে মুহুর্তে কাজ বন্ধ করে দেন সবাই।এলাকাটি খুবই বিপজ্জনক বোঝাতে লাল গামছা কোন এক গাছে বেঁধে চিহ্ন করে দিয়ে ফিরে আসে গ্রামে।আবার অনেক সময় সঙ্গীরা লাঠীসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঘের উপর।দক্ষিরায়ের সাথে লড়াই করে সঙ্গীকে উদ্ধার করেও আনেন।এমন ঘটনার কথা শুনে অন্যান্য মৌলেরা সেইদিন মধু সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেন। নৌকায় ফিরে রাতেই বনদেবী ও দক্ষিণরায়ের নামে বন্দনা করে সকল মৌলের মঙ্গল কামনা জানিয়ে গাছের পাতায় মধুর নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করেন।পর দিন আবার শুরু হয় মধুর চাক খুঁজে মধু সংগ্রহ করা।