মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চারদিকে কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে গেছে এক সময়কার উদ্বাস্তু কলোনি

News Sundarban.com :
জানুয়ারি ৩০, ২০১৮
news-image

ভারত ভাগের শিকার উদ্বাস্তুরা কোন মতে ভারতে এসে মাথা গুঁজেছিলেন বিভিন্ন কলোনিতে।

এরপর বহু দশক পার হয়েছে। সেই শরণার্থীদের জীবনও বদলে গেছে অনেকখানি।

কেমন আছেন তারা? নাজেস আফরোজের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বদলে যাওয়া সেই জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবি।

১৯৬৬ সালে তোলা অঞ্জনা ভট্টাচার্যের ছবি। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ছেন, একই সঙ্গে দক্ষিণ শহরতলি গড়িয়ার কাছে একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করছেন। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথেই, বাড়ির কাছে তাঁর কাকা মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্য এই ছবিটি তুলেছিলেন।

তাঁর জন্ম পূর্ববঙ্গেই, পটুয়াখালীতে। দেশভাগের পরে ১৯৪৯ সালে জেঠা, বাবা, কাকাদের সঙ্গেই অঞ্জনাও চলে এসেছিলেন ভারতে।

দক্ষিণ কলকাতায় টালির নালা বা আদিগঙ্গার পাশে ১৯৫০ সাল নাগাদ গড়ে ওঠা নতুন কলোনি এলাকা বিধান পল্লীতে জায়গা হয়েছিল ভট্টাচার্য পরিবারের।

নিচু, জলা জমি – জোয়ারের সময়ে পাশের আদি গঙ্গার জল কলোনির জমিতে, ঘরে ঢুকে পড়ত।

প্রায় ৫১ বছর পরে, ঠিক সেই একই জায়গায়। আশপাশের খোলা প্রান্তর আর নেই।

আগে ওই মাঠ থেকেই দেখা যেত বহু দূরে গড়িয়া থেকে বালিগঞ্জ বা শিয়ালদার দিকে ট্রেন যাচ্ছে।

কিন্তু এখন চারদিকে কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে গেছে এক সময়কার উদ্বাস্তু কলোনি।

তবে, ওই জায়গাতেই, একইভাবে শাড়ি পড়ে অঞ্জনা ভট্টাচার্য। তাঁর বয়স এখন প্রায় ৭৪-৭৫। কলেজের অধ্যাপনার চাকরীর শেষে এখন অবসর নিয়েছেন তিনি।

বিজয়গড় কলোনির রাস্তা, ১৯৫০ সাল: দক্ষিণ কলকাতায় গড়ে ওঠা প্রথম কলোনিগুলির অন্যতম। সব থেকে বড় উদ্বাস্তু কলোনিও এটিই। এই অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যারাক ছিল বেশ কয়েকটি। অনেকগুলি ব্লকে ভাগ হয়ে গড়ে উঠেছিল এই কলোনি।

বাঁশের বেড়া, গোলপাতা বা হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি ছাদ – এইভাবেই তৈরি হত কলোনির বাড়ি।

কিছু বাড়িতে, বা দোকানে ছিল টিনের ছাদ – ঠিক যেরকমটা দেখা যায় ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারার মতো হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্রে।

সে ছাড়া উদ্বাস্তু কলোনিগুলির টুকরো টুকরো ছবি রয়ে গেছে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত অ্যালবামেই। কোনও সংগ্রহ নেই সেগুলোর।

বিজয়গড় কলোনির প্রধান সড়ক, ২০১৭ সালে তোলা ছবি। এখন ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটা-চলা করাই দুষ্কর।

রাস্তা দিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা নানা ধরণের গাড়ি চলতে থাকে, সকালে বিকেলে বাজার বসে। মাটির রাস্তা হয়ে গেছে অ্যাসফল্টের।

মায়ালতা রায়: ১৯৭৩ সালে তোলা এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে সুখরঞ্জন রায়ের পরিবারকে।

কুমিল্লা থেকে দেশভাগে অব্যবহিত পরেই তিনি চলে আসেন ভারতে। পূর্ববঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সুখরঞ্জন।

ভারতে আসার পরে, ১৯৫১ সালে তাঁর বিয়ে হয় মালদার হরিশচন্দ্রপুরের বাসিন্দা মায়ালতার সঙ্গে। এই ছবিতে সুখরঞ্জনের পাশে তাঁর স্ত্রী মায়ালতা দাঁড়িয়ে আছেন।

বিয়ের পরে টালিগঞ্জের একটি উদ্বাস্তু কলোনি – রিজেন্ট কলোনিতে বাসা বাঁধেন রায় দম্পতি।

মায়ালতা রায় ও তাঁর পরিবারের পুরনো ছবিটা তোলা হয়েছিল যে জায়গায়, সেই বাড়ি আর নেই। সেখানে উঠেছে তাঁদেরই নতুন বাড়ি।

পুরনো ছবিটা তোলা হয়েছিল যে জায়গায়, ঠিক সেই জায়গাতেই, নতুন বাড়ির একটি ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন ৮৭ বছর বয়সী মায়ালতা, ২০১৬ সালে।

অঞ্জনা ভট্টাচার্যের ছোট বোন ভাস্বতী। ১৯৫৮ সালে তাঁদের বিধান পল্লীর বাড়িটা ঠিক এরকম দেখতে ছিল। পুরনো বাড়িটা আর নেই।

বাঁশের কঞ্চির বেড়া দেওয়া ঘরের বদলে ঠিক সেই জায়গাতেই উঠেছে ইটের ঘর।

পুরনো ছবিতে যেসব গাছপালা দেখা যাচ্ছে, সেগুলোরও প্রায় কিছুই নেই আর।

বিজয়গড় কলেজের ব্যারাক ভবনের সামনেই ছাত্রদের মাঝে অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী। তিনিই ছিলেন ওই কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল। দেশভাগের আগে ঢাকায় শিক্ষকতা করতেন তিনি। কলকাতায় এসে একটি সরকারী চাকরিও পেয়েছিলেন।

কিন্তু উদ্বাস্তু কলোনি কমিটির সদস্যরা তাঁকে অনুরোধ করেন সদ্য তৈরি হওয়া কলেজটির দায়িত্ব নিতে।

তখন সরকারি চাকরির থেকেও কম বেতনে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যক্ষ হিসাবে।

কলোনি থেকেই কলেজের পিছনে তাঁকে কিছুটা জমিও দেয়া হয়েছিল বাড়ি করার জন্য।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকে ওই অঞ্চলের প্রাণ কেন্দ্র সেন্ট্রাল রোড আর ইব্রাহিমপুর রোডের সংযোগস্থল, ১৯৬১ সালে। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন করা হচ্ছে। প্রায় সকলেরই পরনে ধুতি বা পাজামা-পাঞ্জাবি।

ওই একই জায়গা – ২০১৭ সালে।

ঠিক আগের মতোই সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীর আশায়। কিন্তু আশপাশের দোকান, মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ – সবই বদলে গেছে।

বিজয়গড় কলেজ, ৫০-এর দশকে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনানীদের ব্যারাক হিসাবে ব্যবহৃত হত।

দেশভাগের পরে যখন উদ্বাস্তুরা ওই এলাকায় জমি দখল করে কলোনির পত্তন শুরু করলেন, সেই সময়ে তাঁরা দখল করে নিয়েছিলেন পরিত্যক্ত ব্যারাকটিও।

সেখানেই গড়ে উঠেছিল উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য কলেজ। উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রত্যেক অঞ্চলে ছিল স্কুল।

ভিটে মাটি – সব হারানো উদ্বাস্তু পরিবারগুলো মনে করত ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলে কোনওমতে একটা চাকরিবাকরি জোটাতে পারলেই আবারও ঘুরে দাঁড়ানো যাবে।

সেই আশাতেই প্রত্যেক উদ্বাস্তু কলোনিতে তৈরি হয়েছিল স্কুল, হয়েছিল বেশ কিছু কলেজও।

বিজয়গড় কলেজ, ২০১৭

বিজয়গড় কলেজের নাম এখন জ্যোতিষ রায় কলেজ। ব্যারাক ভবন ভেঙ্গে তৈরি হয়েছে নতুন বহুতল কলেজ ভবন।

ছাত্রছাত্রী যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে কলেজের আয়তন, পড়ানোর বিষয়ের সংখ্যাও।

পুরনো ছবিটা যেখান থেকে তোলা হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকেই ২০১৭ সালে তোলা এই নতুন ছবিটি।

উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর পুরনো বাড়িঘর এখন আর নেই বললেই চলে।

কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার পুরনো কলোনি এলাকাগুলোতে ঘুরলে হাতে গোণা এরকম কয়েকটি ঘর খুঁজে পাওয়া যায় – যেগুলো ঠিক সেই আগেকার মতোই রয়েছে। সেরকমই একটি ঘর চিত্তরঞ্জন কলোনিতে।

যাদবপুরের বাসিন্দা অরিন্দম চক্রবর্তীর পরিবারে বলি দেয়ার এই খাঁড়াটি ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের পুরনো।

ঢাকার গোবিন্দপুর গ্রামে চক্রবর্তী পরিবারের কালী মন্দিরে ব্যবহৃত হত এটি।

দেশভাগের পরে যখন সবাই ভিটে ছেড়ে চলে এলেন ভারতে, ১৯৫০ সালে খাঁড়াটিও নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা।

উদ্বাস্তুরা ভারতে চলে আসার পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের একটি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দিত।

সেখানে নাম, বর্তমান ঠিকানার সঙ্গেই লেখা থাকত পূর্ববঙ্গের কোন জেলার কোন গ্রাম থেকে এসেছেন তিনি।

একটি বহুতল থেকে তোলা এই ছবিতে যতটা এলাকা দেখা যাচ্ছে, সেটাই এক সময়কার উদ্বাস্তু কলোনি।

মাঝখানে কলকাতা দূরদর্শনের সম্প্রচার টাওয়ার – ডানদিকের সবুজ প্রান্তরটি গল্ফ ক্লাব, আর সামনে বা বাঁদিক থেকে প্রায় দিকচক্রবাল রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত একের পর বিজয়গড় কলোনি, গান্ধী কলোনি, রিজেন্ট কলোনি।

এর থেকেই আরও বাঁয়ে যাদবপুর, শহীদনগর কলোনি, বা আরও দূরে টালিগঞ্জ এলাকার পুরনো উদ্বাস্তু কলোনিগুলি তৈরি হয়ে উঠেছিল।