শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

যে দেশটির নারী সৈনিকের ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা

News Sundarban.com :
নভেম্বর ২৩, ২০১৭
news-image

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী উত্তর কোরিয়ার। কিন্তু দেশটির নারী সৈনিকের ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনটাই জানালেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক নারী সৈনিক লি সো ইয়ন।

প্রায় দশ বছর ধরে ইয়নকে শুতে হয়েছিল একটা বাংক বেডের নিচের তলায়। ঘরটা তাকে শেয়ার করতে হতো আরও পঁচিশ নারীর সঙ্গে। তাদের প্রত্যেককে উর্দি রাখার জন্য ছোট একটা ড্রয়ার দেওয়া হতো। ড্রয়ারের ওপরে রাখতে হতো ফ্রেমে বাঁধানো দু’টি করে ছবি। একটা উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সুংয়ের, আর দ্বিতীয়টা তার উত্তরসূরী প্রয়াত কিম জং-ইলের।

এক দশকেরও বেশি হলো উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে এসেছেন ইয়ন। তিনি বলেন, আমরা খুব ঘামতাম। যে গদির ওপর আমরা শুতাম, সেটা ছিল ধানের তুষের তৈরি। ফলে আমাদের গায়ের সব গন্ধ সেই গদিতে আটকে থাকত। নারী হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ঠিকঠাক গোসল করতে না পারা। গরম পানি তো পেতামই না। পাহাড়ের একটা ঝর্ণার সঙ্গে হোসপাউপ জুড়ে দেওয়া হত, সেটা দিয়ে গোসলের পানি আসত। তবে তার সঙ্গেই সেই হোস দিয়ে বেরোত সাপ, ব্যাং।

৪১ বছর বয়সী ইয়নের বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যই ছিলেন সেনাবাহিনীতে। ৯০এর দশকে উত্তর কোরিয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়লে স্বেচ্ছায় সেনাবিাহিনীতে যোগ দেন ইয়ন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, বাহিনীতে দু’বেলা অন্তত খাবার মিলবে। একই কারণে দেশের আরও অনেক মেয়ে সে সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে অবশ্য দেশপ্রেমের একটা চেতনাও কাজ করেছিল। ১৭ বছরের ইয়ন তার সৈনিকের জীবন মোটামুটি উপভোগও করছিলেন।

পুরুষ ও নারী সৈনিকদের দৈনন্দিন রুটিন প্রায় একই ধরনের ছিল। কঠোর শারীরিক পরিশ্রম, খাবারের রেশনে টান ইত্যাদি নানা কারণে ইয়ন ও তার সতীর্থ সেনাদের শরীরে অল্প দিনের ভেতরে প্রভাব পড়তে শুরু করে।

তিনি বলেন, বাহিনীতে ঢোকার এক বছরের মধ্যে আমাদের আর ঋতুস্রাব হতো না। চরম অপুষ্টি আর ভীষণ মানসিক চাপে থাকতাম বলেই এমনটা হয়েছিল। নারী সৈনিকরা অবশ্য এতে খুশি ছিল। কারণ পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ ছিল যে, মাসিক হলে তাদের আরও শোচনীয় অবস্থায় পড়তে হতো। কারণ ঋতুস্রাবের দিনগুলোর জন্য কোনো ব্যবস্থাই বাহিনীতে ছিল না। অনেক সময় নারী সহকর্মীদের বাধ্য হয়ে একজনের ব্যবহার করা স্যানিটারি প্যাড অন্য একজনকে ব্যবহার করতে হয়েছে।

২০১৫ সালে উত্তর কোরিয়া নিয়ম করে, ১৮ বছর বয়সের পর সে দেশে সব মেয়েকে বাধ্যতামূলকভাবে সাত বছর সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হবে। সে সময় সরকার ঘোষণা করে, বাহিনীর বেশির ভাগ নারী ইউনিটে একটি দামী প্রিমিয়ার ব্র্যান্ডের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হবে। এরপর ‘পিয়ংইয়ং প্রোডাক্টস’ নামে একটি কসমেটিক কোম্পানি সম্প্রতি বিভিন্ন নারী সেনাদের ইউনিটে তাদের কিছু পণ্য বিলি করেছে।

দেশটির গ্রামীণ এলাকায় মোতায়েন বহু নারী সেনার এখনও আলাদা শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ নেই। গবেষকরা জানিয়েছেন, অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীদের সামনেই তাদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয়। এর ফলে তাদের ওপর যৌন হামলার ঝুঁকিও বাড়ে।

উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীতে যৌন নির্যাতন ও লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটে ব্যাপক হারে। ইয়ন জানান, ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিনি। ওই সময় তার অনেক নারী সহকর্মীকে ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কাজের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোম্পানি কমান্ডার নিজ ঘরে বসে থাকতেন ও অধীনস্থ নারী সেনাদের মধ্যে কাউকে সেখানে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করতেন। এটা চলতো দিনের পর দিন।

২৮ বছর বয়সে চাকরি ছাড়ার পর ২০০৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ইয়ন। কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টায় চীন সীমান্তের কাছে ধরা পড়ে যান। এজন্য এক বছর বন্দী শিবিরে কাটাতে হয়। জেল থেকে বেরোনোর কয়েকদিন পর তুমেন নদী সাঁতরে চীনের ভেতরে ঢুকে পড়েন ইয়ন। সেখান থেকে এক দালাল তাকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢোকার ব্যবস্থা করে দেন।

সূত্র: বিবিসি।