শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাংবাদিক হত্যা, তদন্তে নেমে পুলিশ বেশ কিছু প্রমাণ যোগাড় করেছে

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৭
news-image

ব্যাঙ্গালোর শহরে যে নারী সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্তে নেমে পুলিশ বেশ কিছু প্রমাণ যোগাড় করেছে।সিনিয়র সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে মঙ্গলবার রাতে তার নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়।পুলিশ বলছে, মিজ লঙ্কেশের বাড়ির সামনে থাকা দুটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা যোগাড় করেছে, যেখানে আততায়ীদের পরিচয় সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যেতে পারে বলে তারা মনে করছে।তবে দুটি ক্যামেরার রেকর্ডারেই পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে।
তদন্তকারীরা অবশ্য বিবিসিকে এটা নিশ্চিত করেছেন যে, হত্যাকারীরা মোটরবাইকে চেপে এসেছিল। হামলা চালানোর আগে থেকেই তারা মিজ লঙ্কেশকে অনুসরণ করেছিল বলেও পুলিশ মনে করছে।ওদিকে ময়না তদন্তের পরে তার মরদেহ সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা রয়েছে।গৌরী লঙ্কেশ ঘোষিতভাবেই দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত কলম ধরতেন। প্রশ্ন তুলতেন হিন্দুত্ববাদ নিয়ে।

তাঁর লেখার কারণে মানহানির মামলা করেন এক বিজেপি সংসদ সদস্য। ওই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলও খাটতে হয়েছিল মিজ লঙ্কেশকে। তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন।গৌরী লঙ্কেশের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দক্ষিণপন্থী মতবাদ নিয়ে চলা বেশ কয়েকটি সংগঠনের কাছ থেকে নিয়মিত হুমকি পাচ্ছিলেন তিনি।লেখিকা ও সাংবাদিক রাণা আয়ূব বলছেন, “এই হত্যাকাণ্ড তারাই ঘটিয়েছে, যারা গৌরীর কথায় ভয় পেত”।

সাহিত্যিক ও লেখক মঙ্গলেশ ডবরালের কথায়, “এই হত্যা নিশ্চিতভাবেই তাঁর মতামতের সঙ্গে সম্পর্কিত। গত দুবছর ধরে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো টার্গেট করেছিল গৌরীকে।”গৌরী লঙ্কেশের আগেও দক্ষিণপন্থীদের সমালোচনাকারী বেশ কয়েকজন লেখক, যুক্তিবাদী নিহত হয়েছেন।

নরেন্দ্র দাভোলকর:
২০১৩ সালের অগাস্টে হত্যা করা হয় নরেন্দ্র দাভোলকরকে।অন্ধবিশ্বাস বিরোধী ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা মি. দাভোলকর ছিলেন মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা।যেসব চমৎকারী কাণ্ডকারখানা নানা সাধু-সন্তরা দেখিয়ে থাকেন, তার পেছনে লুকিয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিগুলো তিনি ফাঁস করে দিতেন।প্রায় তিন দশক ধরে এইসব ভণ্ড সাধুবাবাদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন তিনি।

হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই ঘটনার প্রায় তিন বছর পরে গ্রেপ্তার করেছিল হিন্দু জনজাগরণ সমিতি নামের একটি সংগঠনের নেতা বীরেন্দ্র তাঁবড়েকে।বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, মি. দাভোলকরের ওপরে যে দুজন গুলি চালিয়েছিল, তাদের শনাক্ত করা গেছে, কিন্তু এখনও গ্রেপ্তার হয় নি কেউ।

গোবিন্দ পানসারে:
২০১৫ সালে মহারাষ্ট্রেরই এক কমিউনিস্ট বিধায়ক গোবিন্দ পানসারেকে হত্যা করা হয়।ভোরবেলায় মোটরবাইকে চেপে এসে দুষ্কৃতিরা গুলি চালিয়েছিল।পাঁচ দিন পরে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।তিনিও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রচার চালাতেন।নিহত হওয়ার কিছুদিন আগেই গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।

একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা সমীর গায়েকোয়াড়কে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।পরে তিনি জামিন পান।আর দাভোলকর হত্যাকাণ্ডে আগে ধৃত বীরেন্দ্র তাঁবড়েকেও মি. পানসারে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়।
কিন্তু আসল হত্যাকারীদের এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি।

এম এম কুলবর্গী:
যুক্তিবাদী ও দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিহত হওয়ার সবথেকে আলোচিত ঘটনাটি কুলবর্গী হত্যা।লেখক ও যুক্তিবাদী নেতা এম এম কুলবর্গীকে কর্ণাটকে তাঁর বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।সেখানেও হত্যাকারীরা মোটরবাইকে চেপে এসেছিল।একজন নিজেকে মি. কুলবর্গীর ছাত্র পরিচয় দিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে।তদন্তে নেমে পুলিশ খতিয়ে দেখেছে যে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে মূর্তিপুজোর বিরুদ্ধে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার সঙ্গে ওই হত্যার কোনও সম্পর্ক আছে কী না।ওই বক্তব্যে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং মি. কুলবর্গীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করেছিল তারা।

লঙ্কেশ হত্যার প্রতিক্রিয়া:
মঙ্গলবার রাতে গৌরী লঙ্কেশের হত্যার খবর প্রচারিত হতেই সামাজিক মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে, যার অনেকগুলিতেই দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদকে এই হত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে।তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস এবং বিজেপি’র নেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনেকেই মিজ লঙ্কেশের হত্যার নিন্দা করেছেন এবং তাঁদের সংগঠনগুলো বা ভাবধারার সঙ্গে যে এই হত্যার কোনও সম্পর্ক নেই, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠছে যে কেন একই ধরণের চিন্তাভাবনার মানুষরা নিহত হচ্ছেন – একই কায়দায়।

ভারতের প্রখ্যাত টিভি সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই টুইট করেছেন, “পানসারে, কুলবর্গী, দাভোলকর, লঙ্কেশ, এর পরে কে? কী হচ্ছে এটা? কেন আগের ঘটনাগুলোয় হত্যাকারীদের ধরা গেল না এখনও?”সাংবাদিক ও সম্পাদক শেখর গুপ্তার টুইট মন্তব্য, “সাহস ছাড়া সাংবাদিকতা হয় না। বিরোধী কণ্ঠস্বর ছাড়া গণতন্ত্র চলে না। গৌরী লঙ্কেশের দুটোই ছিল।”আরেক টিভি সাংবাদিক বরখা দত লিখছেন, “ভারতে আমরা রাম রহিমের মতো ভণ্ডদের সামনে মাথা ঝোঁকাই আর যুক্তিবাদীদের হত্যা করি।”গৌরী লঙ্কেশের ঘনিষ্ঠ লেখিকা রাণা আয়ূব টুইট করেছেন, “এই দেশের প্রতিটা রাস্তায় এখন গডসে’রা ঘুরছে। ভারত, তোমার লজ্জা হয় না এখনও?”তবে এইসব মন্তব্যের বিরুদ্ধ স্বরও শোনা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।

জাগৃতি শুক্লা নামে সাংবাদিক ও টুইট ব্যবহারকারী লিখেছেন, “তাহলে ‘কমি’ [কমিউনিস্ট] গৌরী লঙ্কেশকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তোমার কৃতকর্ম সবসময়েই তোমার কাছে ফিরে আসবে, এমনটাই বলা হয়। আমেন। যারা রক্তাক্ত বিপ্লবে বিশ্বাস করে, তারাই এখন গৌরী লঙ্কেশের পরিণতিতে শোক প্রকাশ করছে। কেমন লাগে যখন নিজের দিকে আঘাতটা আসে?”গৌরী লঙ্কেশের হত্যার প্রতিবাদে আজ (বুধবার) সকাল থেকেই নানা সাংবাদিক সংগঠন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।
ব্যাঙ্গালোর ছাড়াও দিল্লিতে জাতীয় প্রেস ক্লাব, নারী সাংবাদিকদের সংগঠন উইমেনস প্রেস কোর কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরের প্রেস ক্লাব আজ দিনের বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ দেখাবে।কোথাও মিছিল হচ্ছে, কোথাও সন্ধেবেলায় মোমবাতি নিয়ে বিক্ষোভের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।