শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অপরিকল্পিত শিল্পায়ন সুন্দরবনের ধ্বংসের কারণ

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৭
news-image

সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় এর অবস্থান। যা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিস্তৃত। ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। এই অসাধারণ ম্যানগ্রোভটি ১৯৯৭ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপ। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাড়ি, বিল মিলিয়ে জলের এলাকা। বনভূমিটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ৫০০ বাঘ ও ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সুন্দরবনের আক্ষরিক অর্থ ‘সুন্দর জঙ্গল’ বা ‘সুন্দর বনভূমি’। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এ রকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে ‘সমুদ্র বন’ বা ‘চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)’ (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ।
৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বনভূমিটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা বাদাবন। সুন্দরবনে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, লবণ পানির কুমির, ছয় প্রজাতির ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। ৩৩৪ প্রজাতির চিরসবুজ বৃক্ষরাজি, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এ বনভূমিকে সমৃদ্ধ করেছে। ৩১৫ প্রজাতির পাখি ও ২১০ প্রজাতির সাদা মাছের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এই বাদাবন। এসব প্রাণী ও বৃক্ষরাজির বংশবিস্তার ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গত বছরের ২১ জানুয়ারি শরণখোলা রেঞ্জের সাতটি, চাঁদপাই রেঞ্জের চারটি, খুলনা রেঞ্জের চারটি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের তিনটি অর্থাৎ, মোট ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে বন বিভাগ অভয়ারণ্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো কমিশন সাতটি কম্পার্টমেন্ট এলাকাকে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ অভয়ারণ্য নাম দিয়ে বিশ্বের ৫২২তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা ঘোষণা করে। ‘বিলুপ্তপ্রায়’ তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন রক্ষায় ২০১২ সালে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের তিনটি এলাকার নদ-নদীকে ‘ডলফিন অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা হয়। বাদাবনের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ১৮টি নদ-নদী ও খালে মাছসহ সব ধরনের জলজপ্রাণী আহরণও নিষিদ্ধ করা হয়। সুন্দরবন সুরক্ষায় ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে অভয়ারণ্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যতœবান হবে, আমরা এমনটিই দেখতে চাই। পাশাপাশি অবৈধভাবে বন নিধন এবং বাঘ ও হরিণ শিকার বন্ধেও নিতে হবে পদক্ষেপ। এটি সরকারের আশু করণীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীব ও পরিবেশের অনন্য নিদর্শন বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি আমাদের এই সুন্দরবন। এর ওপর ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। এ বনভূমির সুরক্ষার অন্যতম অনুষঙ্গ একদিকে যেমন বাঘ, অন্যদিকে পরোক্ষভাবে এ সুন্দরবনই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ বঙ্গকে রক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। সেদিক থেকে বিপুল প্রাণবৈচিত্র্যে আধার এ বনভূমি কেবল বাংলাদেশের সম্পদ নয়, উপরন্তু বিশ্বসম্পদও বটে। সুতরাং সর্বতোভাবে একে রক্ষা করা জরুরি।
সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনের ধ্বংসের পেছনে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, ইচ্ছামতো গাছপালা কাটা এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাপ অনুঘটক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখছে। এসব অনুঘটক যতটা প্রাকৃতিক, এর চেয়ে ঢের বেশি মানবসৃষ্ট। তবে অস্বীকারের জো নেই, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সুন্দরবনের ওপর স্থানীয় জনসাধারণের নির্ভরশীলতা অনেক প্রবল। এক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট অনুঘটকগুলো প্রতিরোধ যেমন জরুরি, তেমনি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। প্রয়োজনে তাদের বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় আরো সম্পৃক্ত করতে হবে। সুতরাং, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকার সুন্দরবন রক্ষায় টেকসই ও ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেবে-এটাই প্রত্যাশা।

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা