বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মিরকাদিমের গরু এবং…

News Sundarban.com :
আগস্ট ২৮, ২০১৭
news-image

প্রতিবছর কোরবানির গরুর হাট থেকে ফেরার পথে কসম কাটেন বাচ্চু মিয়া। আর যাই হোক, গরু পুষবেন না। সারা বছর গরুকে ভালোমন্দ খাইয়ে মোটাতাজা করেন। ওষুধপত্রের ধার ধারেন না। প্রাকৃতিক খাবারই ভরসা। এত কষ্ট করে নাদুস-নুদুস গরুকে পুরান ঢাকার গণি মিয়ার হাটে (রহমতগঞ্জ হাট) তোলেন। অথচ বিক্রির পর গড়পড়তায় লোকসান গুনতে হয়! এও কি পরানে সয়? সয়। মিরকাদিমের বাচ্চু মিয়ার মতো মানুষের সয়। যে কারণে কিরা-কসম কাটার মাস তিনেক পরে ভারতের ওড়িশার জঙ্গলি, নেপালি আর ভুটানের বুট্টি গরুর বাছুর খুঁজে বেড়ান। সব সময় যে সুবিধামতো পাওয়া যায়, তা নয়। যা পান তাই পেলে পুষে বড় করেন। এটাই বাচ্চু মিয়াদের আনন্দ।
মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম জায়গার নামটি মানুষের মুখে মুখে। সারা দেশে কমবেশি সবাই চেনে। গরুর কল্যাণে। একসময় ওই এলাকায় কুলুদের রমরমা ছিল। দিনরাত ঘানি বয়ে বেড়াতো বলদ। খৈ, ভুসির অভাব নেই। গেরস্থবাড়ির গরুরও খাবারের অভাব নেই। খৈল, ভুসি ওপরেই থাকত। চালের ভুসি, গমের ভুসি, খেসারির ভুসি, বুটের ভুসি। খোলা মাঠে ঘাস খাওয়ার সময় কোথায়! খুদের ভাত, ভাতের মাড় মাটির চাড়িতে টইটম্বুর হয়ে থাকত। বাড়ির ছেলেপুলের মতোই বড় হতো গরু। আদরে বড় হওয়া গরুর কদরও বেশ। সুস্বাদু মাংস। কোরবানির হাটে ঢাকাইয়াদের পছন্দ তাই মিরকাদিমের গরু। তাদের আভিজাত্যের অংশ এই গরু। খান্দানের ইজ্জতের ব্যাপার। তাই যুগের পর যুগ ধবল ষাঁড়, বলদ কিংবা বাঁজা গাভির আদর-কদর দুটোই আছে তাদের কাছে।
রহমতগঞ্জ হাট (সাবেক গণি মিয়া হাট) একসময় ছিল শুধু মিরকাদিমের গরুর জন্য। কোরবানির আগে এক সপ্তাহে কয়েক হাজার গরু বিক্রি হতো। দর কষাকষি হতো কম। তাই ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেই খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতেন। এখন আর আগের মতো গরুর আমদানি নেই। মিরকাদিমে কুলুর বাড়ি কমে গেছে। অনেকের ঘানি নেই। কুলুরা পেশা বদলেছেন। যে যার মতো জীবিকা খুঁজে নিয়েছেন। প্রভাব পড়েছে গেরস্থবাড়িতে। খৈল-ভুসির দাম চড়া। চড়া দামের খাবার খাইয়ে গরু পুষতে গেলে পড়তায় পড়ে না। শেষে দশা হয় বাচ্চু মিয়ার মতো। লোকসান গুনতে হয় খামারিকে। যে কারণে মিরকাদিমের গরুর কদর থাকলেও জোগান কমে গেছে। এখন হাতেগোনা কিছু মানুষ মিরকাদিমের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে ঢাকাইয়াদের কাছে দুধ ধবল গরুর চাহিদার সুযোগে কিছু অসাধু অন্য জাতের গরুকে মিরকাদিমের গরু বলে চালিয়ে দিচ্ছে, এমনও শোনা যায়। দেখতে ছোটখাটো শারীরিক গঠন, পাগুলোও খুব বড় নয়, ছোট মাথার নাদুস-নুদুস গরু যারা চেনে, তাদের ঠকার শঙ্কা নেই বললেই চলে। প্রতিটি গরুর দাম ৮০ হাজার থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত।

মিরকাদিমের গরু বৈশিষ্ট্যেও আলাদা। একই জাতের অন্য গরুর সঙ্গে মেলে না। বাইরের দিকটা বেশ তেলতেলে ও গোলগাল। খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় এখানকার ঘরে ঘরে বিশেষ জাতের গরু পোষা হতো। এটাই ছিল খামারিদের আনন্দ। বুট্টি ছাড়াও ম-ি, হাঁসা, পশ্চিমা ও সিন্ধি জাতের গরুও পাওয়া যায়। মিরকাদিমের গরুর মধ্যে গাভিই বেশি। কারণ? ঢাকাইয়াদের খাবারে একটু ভিন্নতা আছে। মাংসের হরেক পদ তাদের পছন্দ। বিশেষ করে কাবাব। গাভিতে চর্বি কম থাকে। কাবাব ভালো হয়। তাছাড়া গাভির ওলানের খিরি কাবাবও পুরান ঢাকার মানুষের কাছে বেশ প্রিয়।
গরু পালন সহজ কাজ নয়। বেশ ধকল পোহাতে হয়। নিয়মিত নাওয়া-খাওয়া দিতে হয়। নতুন গামছায় গোসল দিতে হয়। সন্তানের মতো চোখে চোখে রাখতে হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকতে দিতে হয়। কোনো ধরনের ওষুধপত্র খাওয়ানো হয় না। শরীর স্বাস্থ্য যতটুকু বাড়ে পুরোটাই প্রাকৃতিক খাবারে। যতœআত্তি কম হলে কাজ হবে না। মিরকাদিমের সাদা গরু নামে পরিচিতি আছে। সাদা গরু এখন খুব একটা পাওয়া যায় না। তাই অন্য রঙের গরুও গোয়ালে তোলেন খামারিরা। মিরকাদিমের গরুর পরিচিতি সারা দেশে আছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ ঐতিহ্য এখন বিলীনের পথে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার মানুষের কাছে কোরবানিতে মিরকাদিমের গরু মানে আভিজাত্য। লালন-পালন খরচ বেশি। বিক্রি করতে গেলেও আশানুরূপ দাম পাওয়া যায় না। খামারির পরিশ্রমের টাকাও ওঠে না। মিরকাদিমের ঘরে ঘরে গরু পোষার সেই চিত্র এখন আর দেখা যায় না। কিছু খামারি কোরবানির হাটকে সামনে রেখে গরু পোষেন। তবে সংখ্যায় তারা খুব বেশি নন। মিরকাদিমের গরুর ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। গরু পোষার সুদিন ফিরে আসুক মিরকাদিমে।