মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শাহীন রেজা : কবিতার এক জীবন     

News Sundarban.com :
মে ২৯, ২০২২
news-image

মধুবন চক্রবর্তী 

কবি কীভাবে জন্ম নেন, কবিতা আদৌ কি ঈশ্বরের দান নাকি এক অমোঘ প্রাপ্তি, নাকি অন্ধকার থেকে আলোর জগতে উত্তরণ, কবিতা মস্তিষ্কের কোন গহ্বর থেকে উঠে আসে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দুঃখের জন্ম কি দুঃখ থেকেই– এই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে; যা বৃহৎ অন্বেষণ। যার উত্তর সারাজীবন খুঁজলেও কেউ কেউ হয়তো পেতে পারে ঠিক ঝিনুকের শরীর থেকে মুক্ত পাওয়ার মতো। আবার অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, সহজ কথায় কবিতার জন্ম আনন্দ থেকে। যার উদ্দেশ্য, আনন্দ বিতরণ। কবিতার মধ্যে মনের যে জটিল বহুস্তরীয় প্রকাশ, তার অনেকটাই ধরা পড়ে, কবিতার ক্যানভাসে। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর যেন কবি শাহীন রেজার কবিতার ক্যানভাসে । মাঝে মাঝে মনে হয় বীণা হাতে যেন স্বরস্বতী দাঁড়িয়ে। কখনও ভেজানো কপাটের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা একরাশ টাটকা স্মৃতি। প্রেম বিরহ বিচ্ছেদের পথে ঘুরতে ঘুরতে কখনো তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তারই শহরে ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথের । কী অসাধারণ রূপকল্পের বিন্যাস ‘একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আমার শহরে ‘এই কবিতাটিতে। পাঠ করতে করতে যেন চোখের সামনে জীবন্ত কোনো ইতিহাস। কবিতার ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ। মুগ্ধতায় আমিও দেখছি এই শহরটা তারই চোখ দিয়ে।

শাহীন রেজার কবিতা যেন ভেজানো কপাটের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পিতা পিতামহের স্নেহের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা শান্ত কোনো দুপুর। আচমকা বৃষ্টির ভিতর খুঁজে পাওয়া আতরের ভেজা গন্ধ। নীলদিঘিতে জলের নিভৃত শব্দের আনাগোনা। তার কবিতা যত না পড়েছি তার থেকেও বেশি দেখেছি একটি কবিতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা হাজারটা কবিতার রহস্য। শব্দের অন্দরমহলে পর্দানশীন কোটি কোটি সৌন্দর্য কিলবিল করে খেলে বেড়াচ্ছে পোনা মাছের মতন। যখন তিনি বলেন, “তার চোখে যখন মেঘরং ছায়াগুলো নামে, তখন ভালোবাসাগুলো শিং মাগুর কৈ হয়ে যায়, হাঁসের পালে দুপুর লুকিয়ে, আমি মেতে উঠি শ্রাবণের এক্কাদোক্কায়” – কবিতার অন্দরে লুকোচুরি খেলছে এক্কাদোক্কা ছেলেবেলা। গরম ভাতে ঘিয়ের বদলে শিঙি ও কৈ মাছের ঝোল, নদীর মতো ভাসে। অথবা আপনি ভাবতেই পারেন ‘ভালোবাসা’ যেন মনকে কইয়ের মতো চঞ্চল করে তোলে। কবির কল্পনায় কত কী উঁকি দেয়।

কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন ‘কবিতা হলো performance in words’.কবি কোলারিজ বলেছেন, ‘গদ্য মনে শব্দ’। অনেক কবি নানা ভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন তাদের অনুভূতি, আবেগ, কখনো বা বাস্তবের সমূহ চিত্র। তবে শাহীন রেজার কবিতায় আবেগ-অনুভূতি বাস্তব পরাবাস্তব সবকিছুর ভেতরেও একটা বিষয় আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়েছে তা হল তাঁর কবিতার শাস্ত্রীয়, মার্জিত এবং পরিশীলিত ভাবনা। রূঢ়তা বা অতি বাস্তব কখনও ছাপিয়ে যায় না তার কবিতাকে। অতিক্রম করে না কবিতার অন্তর্নিহিত নমনীয়তা। আসলে কবিতার ভাব ও রসের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতের বেশ মিল। রাগ, অনুরাগ, বিরাগ, পূর্বরাগ সব যেন মিলেমিশে একাকার সেখানে।

তার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ঠিক যেন কবিতার মতোই । কোনও একটি বিশেষ লাইভে এই বিশিষ্ট কবির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। এর আগে কোথাও কখনো কাউকে তিনি লিখেছিলেন, আমার কবিতা পাঠ শুনে, ‘মধুবন কে কি কবিতা পাঠের জন্য বলা যেতে পারে’? সেই মন্তব্য দেখে আমি অভিভূত হই। ওপার বাংলার বিদগ্ধ একজন মানুষ আমার কণ্ঠে তার কবিতা ধারণ করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এটাই আমার কাছে ছিল সবচেয়ে ভালো লাগার অনুভূতি। আমিও শ্রদ্ধেয় কবিকে কবিতা পাঠ করে পাঠাই। আর সেই কবিতাই হয়ে ওঠে আমাদের দুজনের সংযোগ স্থাপনের সব থেকে বড় মাধ্যম। বলা ভাল একমাত্র মাধ্যম।

তিনি আমার কবিতার গুরু, অনুপ্রেরণা। যিনি প্রথম আশ্বাস দিয়েছিলেন ‘তুমি আরও লেখ। আরো। তোমার মধ্যে কবিতা রয়েছে। তুমি লিখে যাও।’ এই শব্দগুলো আমার ভেতরে বিদ্যুতের মতন খেলে গেছিল । তারপর আর থামিনি। আজও সাক্ষাৎ হয়নি আমাদের। তবু তাকে দেখছি তাঁর কবিতায়, লেখায়, কথায়। এরকম হয়েছে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি মেসেঞ্জারে, উনি হয়তো ব্যস্ত আছেন, হয়তো দুদিন পর কথা বললেন। কখনও মনে হয়নি যে অনেকদিন পর কথা হচ্ছে। মনে হয়েছে আমি তো তার সঙ্গে অনর্গল কথা বলি কবিতায়। একমাত্র কবিই পারেন তার দিগন্তকে চিহ্নিত করতে। দেহের ভিতর জাগিয়ে তুলতে মনের ভূভাগ। তাই তার কবিতার ভেতরে যে অন্তরঙ্গ নিঃসঙ্গতা, যে একাকিত্ব –তাই অনুরণিত হয়ে ওঠে আমার ভেতরে। সকলের মাঝেও একা তবু তিনি একা নন। এই একাকিত্বের মাঝেই তার কবিতা যাপন। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে শাহীন রেজার পথ চলা কবিতাকে জাপটে ধরে। অমৃতরসের সন্ধানে পরিব্রাজক তিনি। একসময় তিনি ছিলেন আমার গুরু। আজও আছেন। ধীরে ধীরে মহীরূহের মতো অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার কোন ভুল দেখলে দুটো চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে সে ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি। এখন তিনি আমার দাদাও। এইদিনে দাদাকে বুক ভরা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও প্রণাম।

শুভ জন্মদিন দাদা। এই শুভ কামনা শতবর্ষী হোক।