বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জীবনহেমন্তে জীবিত জামালপুর

News Sundarban.com :
অক্টোবর ১২, ২০২১
news-image

জীবনহেমন্তে জীবিত জামালপুর

শামীম আজাদ

প্রেমের গভীরতা যাচাই করতে ইংরাজীতে জিজ্ঞেস করি, ‘ইজ হি জাস্ট এ্যা ফ্রেন্ড অর মোর দ্যান এ্যা ফ্রেন্ড?’ প্রেম হলে উত্তর হয়, ‘ হি ইজ মোর দ্যান এ্যা ফ্রেন্ড।’ আমার দেখা শহরগুলোর কোনটির প্রতি প্রীতি বেশী প্রকাশ করতে গেলে আমার উত্তর হবে,’জামালপুর ইজ মোর দ্যান এ্যা টাউন টু মি। সব শহরকেই বাসিয়াছি ভালো। তবে জামালপুর তোমাকে তার চেয়ে কিছু বেশি।’

লন্ডন, ঢাকা, টাঙাইল, ফেনী, নারায়নগঞ্জ ও জামালপুর সবগুলোই আমার প্রিয় শহর। সবগুলোই আমার বেড়ে ওঠার শহর। এদের সকলের গায়ে গায়ে আমার বয়স গেঁথে আছে। বৃটেনের প্রাণভ্রমরা কবি শেক্সপীয়ারের দেশ লন্ডন। আমার জীবনহেমন্ত সময়ের শহর লন্ডন। এখানেই থাকি।মাঝরাতে রাতে জানালা দিয়ে পেটিকোট লেইন মার্কেটের লাইট পোস্টের ড্যাফোডিলের মত ঝুলে থাকা বাতিতে চূর্ণ বরফ পড়ার শব্দে জেগে উঠি। নদীকে মনে হয় নীল দেয়াল আর তুষারপাতকে মনে হয় জোছনার সোনালী বর্ষা। টেমস নদীতে পিঠ দিয়ে দাঁড়াই জীবন-হেমন্তে, আমার ডালে এখনো দু একটা হলদে পাতা ঝুলছে কি ঝুলছে না বলতে পারবো না। যদি একখানাও থাকে, তবে তা জামালপুরের ।
প্রিয় কবি রফিক আজাদেরও প্রিয় শহর জামালপুর।

নদীকে কেন্দ্র করে যেমন দুপাশে গড়ে উঠে লোকালয়, এখানে একটি রাস্তাই নদীর মত আগলে রেখেছে এই শহরের সব কোল। এর এক মাথায় শেষে সিংহযোনী মানে সিংজানি রেল ষ্টেশন। তার সামনের কলা কচু, মাংস ও মাছের বাজারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জামালপুর গার্লস স্কুলের নীল ড্রেস গলায় সাদা স্কার্ফ ও সাদা কেড্‌স পড়ে রোদে গাল মাথা লাল করে মোখলেস স্যারের হারমোনিয়েমের সঙ্গে “ এলো বন্যা এলো ভাসলো ক্ষেতের ধান…” গান গেয়ে গেয়ে দেশের বন্যার্তদের জন্য পয়সা তুলেছি। গান গাইতে গাইতে শুনেছি ডাহুকের মতো ট্রেনের ডাক।এই রাস্তার শেষে অন্য মাথার দিকে হাসপাতাল, গোলপাতার মত ষ্টেডিয়াম, পাখ পাখালি ভরা পাথালিয়া গ্রাম। পাথালিয়ার রাস্তা থেকে চোখ মেলে দিলে দেখা যেতো নদীর ঐ পারে বিছানা হয়ে একটি বিস্তীর্ণ ও পরিপাটি পাট ক্ষেত পড়ে আছে।

নীল স্কুলড্রেস, সাদা কেডস পরে টিনশেড স্কুলে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে জান্নাত আরা আপার দেয়া দন্ডতেই কপোতাক্ষ তীরের কবিকে চিনেছি। বড় আপা রাবেয়া আহমেদের আশা ও আকাঙ্খার উপ্তবীজের সবগুলো ভিটামিন আমিই প্রথম পেতাম বলে তাঁর আঠা’ই হয়েছিলো আমার নাম।একগুচ্ছ শিক্ষক কী পরম মমতায় ও শাসনে আমার চেতন অবচেতনে আমাকে সে শহরসৈনিক করে তুলেছিলেন বুঝতেও পারিনি।

শহরের মাঝামাঝি থাকতাম আমরা, কন্ট্রাকটর জলীল চাচার বাড়িতে। সে তিমিরঙ টিনশেড বাংলো মার্কা বাড়ির জানালা দিয়ে প্রতি রাতে চাঁদ থেকে কোহিনূর গলে পড়তো। কারন তিন বাড়ি দূর থেকে সদ্য গোঁফওঠা প্রেমিকের খোলা গলার গান ভেসে এসে ভাসিয়ে দিতো এক চতুর্দশী বালিকাকে। বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ তার বাড়ি আসতো। সে আর ঘুমোতে পারতো না। ভোরে বকুলতলায় ফুল কুড়াবার ছলে সেই বালকের সাদা পদ্মের মত পাথরের ব্যালকনির সামনের দিয়ে রাস্তা দিয়ে যেতো।

শহরকে এমনি ভালোবাসা যায় না। সেখানে মানবিক প্রেমেরও একটা সম্পর্ক থাকতে হয়। এমনকি সে শহর চিনতে হলে চিনতে হয় তার কুতুব ও কুকুরদেরও।শেষের কথাটি আমার বাবার।

তাই বেশ ক’জন পাগল আমাদের বাড়ি আসতেন। খড়ের বালিশ বগলে নিয়ে পাকা মরিচের মত ফর্সাবর্ণ এক পাগলা আসতেন। তাকে ভাত খেতে দেবার দায়িত্ব ছিলো আমার আর আমার অসম্ভব সুন্দর চাচাতো বোন রাকুর। আমরা তাকে খড়বাবা ডাকতাম আর তার হুম… শব্দের ভয়ে কেঁপে কেঁপে খাবার দিতাম। তিনি নীল অপরাজিতা ছাওয়া বারান্দায় নিয়মিত স্থানে বসে খেয়ে উঠতেন। সামনে পরীক্ষা থাকলে অংকে দূর্বল রাকু পরম নিষ্ঠার সঙ্গে এক টুকরো লেবু ও কাঁচা মরিচ দিয়েই সম্ভাব্য প্রশ্ন লেখা কাগজ মেলে ধরে জিজ্ঞেস করতো, খের বাবা খালি বলেন এক, তিন না পাঁচ? আঙ্গুল দিয়া দেখাইলেও হবে। কিন্তু কুতুব গমগমে হুম … হুংকার ছাড়া আর কোন শব্দ করতেন না।

আরেক সম্ভাবনাময় কুতুব ছিলেন মাথা কামানো অর্ধ উলঙ্গ আতর আলী। সারা গায়ে মাথায় ফাটানো তরমুজ রস মাখা, পেছনে ঘেউ ঘেউ করা কুকুর ও ঢিল মারা টোকাই নিয়ে। তিনি যে আসিতেছেন তা তার ফলোয়ারদের বিচিত্র ধ্বনি ও তার ফাটা-বাঁশ গলার উচ্চকিত আওয়াজেই টের পেতাম। বাসার সামনে এলেই বাসায় ঢুকে পড়তেন। ভাইয়া ও শুবু হয়তো খেলার মাঠে, আব্বা-আম্মা হয়তো তমালতলায় সামাদ চাচাদের ওখানে। বাসায় শুধু আমি আর বুজান। ভয়ে আতর আলীর আগমনী গীতিতেই সন্ত্রস্ত হয়ে এ্যালসেশিয়ান কুকুর জিপ্পীকে চেইন মুক্ত করে দৈড়ে এসৈ দরজা জানালা বন্ধ করে তার ফুটোতে চোখ রেখে থরো থরো কাঁপতাম। দেখতাম বাইরে চলছে জিপ্পী ও তার এক আজব হাডুডু। মনে হতো বাড়ি গুঁড়িয়ে যাবে।ভয়ে কাতর কন্ঠে ফোন করতাম, আব্বা, আতর আলী… আতর আলী
– কই
– বাইরে
– তুমরা কই
– গরর বিতরে
– তে অত ডরাইরায় কেনে, খাইলাইবো নি? চুপচাপ দুয়ার বন্দ খরি বই থাকো। এতদিনে এখন বুঝি আতর আলী হুঁশের পাগল ছিলেন, তা না হলে কেনো আব্বাকে না দেখে কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু ততক্ষনে বেড়ার ওপারের ছাপড়া দোকানদার নান্নু বেচারার যা হবার হয়ে যেতো। আতর আলীর তাড়ায় জিপ্পী নান্নুর দোকান এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছে!

শীতে দিনে ভোরে আসতো আমারই বয়সী আমার এক শিক্ষকের এক অপ্রকৃতিস্থ কিন্তু অত্যন্ত সুদর্শন পুত্র। অতি ভোরে ত্বক ফালি করা শীতেও কারা যেন তাকে দিয়ে আমাদের বাড়ির বিপরীতে মিউনিসিপালটি অফিসের সামনের চাপ কল থেকে বালতির পর বালতি জল ভরাতেন। কিন্তু দুঃখ বেদনাবোধহীন। ঠান্ডায় ফর্সা মুখখানা লাল আর হাত কুঁচকে যেতো, গঠি ঠি করে কাঁপতো। বাড়ির লোকজন তাকে খুঁজে পেলে ধরে নিয়ে যেতো। আম্মা দেখলেই ডাকিয়ে এনে আমাকে বা রাকুকে দিয়ে গরম খাবার দিতেন। সুন্দর সে পাগল মুহূর্তর জন্য চোখের ঘন পাঁপড়ি মেলে আমার দিকে চেয়ে থমকে যেতো। আমি যে তার বাবার কাছে পড়তে যাই সে চেনা জানার কোন রেশ থাকতো না।

আব্বার ধারণা এঁদের এই উন্মাদদিগের মধ্যেই কেউ একজন নিশ্চয়ই শহর কুতুব হবেন। যদি আসল জন ফসকে যান তাই তাঁদের সকলেরই সেবা করা উত্তম। সেবা তো করতাম আমরা।ভয় পেতাম, বিরক্ত হতাম এঁদের গা থেকে নানান গন্ধ, চোখ থেকে বিভিন্ন ধরণের তেজ ও গলা থেকে রকমারী শব্দ বেরুতো বলে।

আব্বা অধিকর্তা খাদ্য ভবনের।সেখানের পড়ো জায়গায় অবসরে করে তুলেছিলেন সব্জী বাগান।খয়বর আলী চাচা ছিলেন তাঁর সহকারী। স্টেডিয়ামে প্যারেড প্র্যাকটিস শেষে বিস্ময়ে দেখতাম লালাসালুর বিশাল এক পাখা টেনে চলেছে ‘পাঙ্খা পুলার বয়’ আর চাচার হাত ধরে বাইরের বাগান থেকে তুলতাম টমেটো বেগুন।

আজ এত বছর পর লন্ডনে লিখতে বসে অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে আমি কি করে আমার প্রিয় শহরটির পুরো দেহ ও মন এক সাথে দেখতে পাচ্ছি। এর মচমচে মনটা ছিলো ঘন ও মিষ্টি সংস্কৃতির চা’য়ে চুবানো বিস্কুটের মতো। ছোট্ট স্টেডিয়ামে বানিজ্যমেলার মৌসুমে মেতে উঠতাম কি দারুণ উষ্ণতায়। মোটর সাইকেল নিয়ে বাজিকরের ‘মউত কা কুয়া’ আগুনের রিং পেরিয়ে যাওয়ার উন্মত্ততার চাইতে আমার উন্মাদনা কম ছিলো না। সন্ধ্যায় চাঁন মিয়া চাচার বাসায় চলতো গান ও কবিতার রিহার্সেল। দিনের বেলা স্কুল ছুটির পর বন্ধু মন্টির কাঠের দোতলা থেকে পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম আমাদের কিশোর প্রেমিকদের ঘোরাঘুরি।আমাদের বাসায় হিমসাগর গাছে বাঁধা ছিলে দড়ির ঝুলনা। আমি আর মন্টি তাতে ঝুলে ঝুলে মুখস্ত করতাম নজরুলের সিন্ধু, রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। পড়া আগে ভাগে শেষ করলে রাতে বাবার সাথে বেনু কর্মকারের সেতার শুনে রিক্সায় করে ইমন রাগে নিসাগামা পাধানিসা … গুন গুন করে বাড়ি ফিরতাম।

১৪ আগষ্টে হত নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গার্ল গাইডের প্যারেড হতো সকালে। সন্ধ্যার আর্টস কাউন্সিলের অনুষ্ঠানের জন্য আগে থেকেই চলতো প্রস্তুতি। বাসা থেকে দল বেঁধে নদীর পাড় ধরে নাচতে নাচতে তার মহড়ায় যেতাম। এসডিওর বাংলোর পরে, আব্বাদের টেনিস কোর্টের পেছনে মিসেস টি এন রশীদের বাসায়। সেখানে পরান’দার তবলার তেহাইর সংগে গোল করে তুলতাম জামা।তখনকার সে স্বাধীনতা দিবসে হতো নৌকা বাইচ। সবাই ঘাটে ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখতাম বাজনার শব্দে নদীর জলে কী করে চিলের মত উড়ে যাচ্ছে সরু নৌকোর ঠোঁট!

আম্মা তাঁর ‘আপওয়া’র মিটিংএ মন্টিদের পাশে তাদের অফিসে বসলে শুরু হতো আমার আর মন্টির মাতামাতি। মন্টি আমার আব্বা ও আম্মাকে ডাকতো চাচা- খালাম্মা আর আমি ওর বাবা-মা’কে মেষো- মাসিমা বলে। আমাদের বোধে ছিলনা কোন ধর্মের দানব। টুকরো আনন্দে ভরে থাকতো দিন মাস।

আব্বা হয়তো অফিসে। আমাদের স্কুল বন্ধ । আম্মা একটি স্টোভ, চাল-ডাল-মশলা ও কাটা ইলিশ নিয়ে আমাদেরকে নিয়ে নৌকো ভাড়া করে উঠে যেতেন। উল্টো দিকে চর, সেখানে পাটক্ষেত। দু একটা ডিঙি নৌকার মতো আমরাও ধীরে ধীরে চলে যেতাম শহরপ্রান্ত পাথালিয়ার দিকে, যেখানে দেবদারু গাছের মত দীর্ঘ সব জামগাছ। সে জাম গুলো ছিলো স্বাস্থ্যবান ও সরস। ঊপরের পাতলা স্বচ্ছ ঘন বেগুনী পর্দা। নখ লাগলেই তা ফেটে গলে হাত রঙিন হয়ে ওঠতো। নৌকা পাটক্ষেত ঘেঁষে খুঁটি গাড়লে মনাভাই লুঙ্গি কাছা দিয়ে এক গোছা সরস মিষ্টি পাট পাতা তুলে আনতেন। আমরা জাম কুড়িয়ে গায়ে মুখে রঙ ভরিয়ে ফিরে এলে গোলাপের ছবিওলা টিনের প্লেটে ইলিশ মাছ ভাজা, পাট শাক ও রশুন ফোঁড়নের ডাল দেখে আমাদের চোখ চক চক করতো। মাঝি ও মনাভাই ভরা পেটে দাঁড় ধরলে বেনীটি পিঠে ফেলে নদীর জলে হাত ধুয়ে চলন্ত নৌকায় গরম ভাত মেখে খেতে খেতে একটি ছোট মেয়ের মনে হতো এমন সোনালী শহর পৃথিবীর আর কোথাও থাকতে পারেনা।

সব শহরেরই একটা রঙ থাকে। সে রঙের সঙ্গে তার প্রকৃতির মিশ্রণেই খোলে তার রূপ। বুদাপেস্টের রঙ ধূসর। দালানগুলো ফোস্কা পড়া যুদ্ধ বিশ্বস্ত আর তার ঢালেই মেঘরঙা দানিয়ুব নদী। লন্ডনের রঙ প্রাচীন পাথর। পাবগুলো কালো কিংবা কালচে লাল, দালানগুলো গ্রানাইট পাথরের, আকাশটা প্রচন্ড ধাতব। ফেনীর রঙ রূপালী।আর জামালপুরের রঙ সোনালী। ঐ সোনালী শহরেই আমি সব চেয়ে সুন্দর ছিলাম।ঐ শীর্ণ ব্রহ্মপুত্র নদীতীরে জনতা পাঠাগারের পেছনে ঘাটের কাছে দাঁড়ানো চেহারাটাই সব চেয়ে উজ্জ্বল।

জলিষ্ণু জামালপুর
গ্রন্থঃ একলা জেগে রই
প্রকাশকঃ জাগৃতি

রঙিন ছবিগুলো তিনবছর আগের তোলা।এখানে আম্মার ডান পাশের বন্ধু মন্টি আর নেই। তবে মাজু, সাওদা ও নাটকের ছবির বুলবুলির সংগে তিন বছর আগে দেখা হয়েছে (রঙিন ছবিগুলো) আবার এই জীবন হেমন্তে।