বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শতাব্দী প্রাচীন ক্যানিংয়ে ভট্টাচার্য্য বাড়িতে আজও কালো মুখের দুর্গাপ্রতিমা পূজিত হয় 

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১
news-image

বিশ্লেষণ মজুমদার, ক্যানিং:  “এসেছে শরৎ হিমের পরশ,লেগেছে হাওয়ার পরে,সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে। আমলকী বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু পেয়েছে খবর,পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু”।

শরৎ কাল পড়তেই আপমর বাঙালী মেতে ওঠে শারদ উৎসবে। শারদ উৎসবে যখন আপামর রাজ্য তথা দেশবাসী মেতে উঠবে মাতৃ আরাধনায় Iঠিক তখনই অন্যদের মতো দেবী পুজোয় মাতোয়ারা হবেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার  সুন্দরবনের সিংহ দূয়ার নামে খ্যাত বিট্রিশ আমলের ঐতিহ্যবাহী ক্যানিং মহকুমা শহরের দিঘীরপাড় গ্রাম পঞ্চায়েতের ১ নম্বর দিঘীরপাড় গ্রামের ভট্টাচার্য্য পরিবারের সদস্যরা।তবে তাঁদের দেবী প্রতিমা রাজ্য তথা দেশের মধ্যে এক ভিন্ন এবং ব্যতিক্রমী বলেই পরিচিত। অন্যান্য দূর্গা প্রতিমার মুর্তি যেখানে মানবীয় রঙ দিয়ে গড়া হয়ে থাকে, সেখানে এই ভট্টাচার্য্য বাড়ীর শতাব্দী প্রাচীন দুর্গামূর্তির মুখের রঙ কালো। স্বাভাবিক ভাবেই এই কালো মুখের দুর্গা প্রতিমাকেই বংশ পরম্পরায় পুজো করে আসছেন এই ভট্টাচার্য্য পরিবারের বংশধররা।কেন ভট্টাচার্য্য পরিবারের দেবী দুর্গার মুখ কালো হয়? তা জানতে পিছিয়ে যেতে হয় প্রায়  ২২০ বছর আগে। এই ভট্টাচার্য্য পরিবার এক সময় বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামে বসবাস করতেন।

সেই বংশের কালীপ্রসন্ন,কাশীকান্ত,রামকান্ত,রামরাজা ভট্টাচার্য্য’রা মিলিত ভাবেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামেই দুর্গা পুজো শুরু করেন।তা আজ থেকে প্রায় ৪৩৫ বছর আগে অর্থাৎ ১৫৮৫ সালে।তৎকালীন সময়ে জাঁকজমক ভাবে সেই পুজো করা হতো।আবার দেশভাগের পর এই ক্যানিং শহরে ভট্টাচার্য্য পরিবার চলে আসেন ১৯৩৮ সালে।ক্যানিংয়ে চলে আসলেও পুজোর সময় ক্যানিং থেকে স্বপরিবারে বাংলাদেশের বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামে গিয়ে পুজো করে আসতেন ভট্টাচার্য্য পরিবারের সদস্যরা। এখানে অবশ্য ৭৪ তম বর্ষে পড়লো এই পুজো।আবার এই ক্যানিংয়ে সর্বপ্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন ভট্টাচার্য্য পরিবারের সদস্য ইন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য্য।

প্রতিমার রঙ কালো হয় কেন সেই প্রসঙ্গে বর্তমান পরিবারের সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে বাংলাদেশেই দুর্গা পুজোর সপ্তমীর দিন পাশের মনসা মন্দিরের জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা থেকে কোন প্রকারে একটি কাক জ্বলন্ত সলতে নিয়ে মন্ডপের উপর বসে। সেই সলতের আগুনে আগুন লেগে যায় সোন দিয়ে তৈরি দুর্গা মণ্ডপে চালা ঘরে।আর মুহূর্তের মধ্যেই সেই বিধ্বংসী অগ্নি শিখার লেলিহান আগুন গ্রাস করে নেয় সমগ্র পুজো মণ্ডপকে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পায়নি স্বয়ং দেবী দুর্গাপ্রতিমার মুর্তিও।এই আকষ্মিক দুর্ঘটনায় ভেঙে পড়ে সমগ্র ভট্টাচার্য্য পরিবারের সকলে সদস্য।অনেক সাধারণ মানুষজন সেই সময় তাঁদের ওপর দেবী মা দুর্গা রুষ্ট হওয়ার কথাও জানায়।পাশাপাশি প্রতিবেশী পড়শীরা বলেন “মা তোদের হাতে আর পুজো চাইছেন না। যার জন্য আগুনে মায়ের মূর্তি পুড়েছে”।

এই কথা শোনার পর ভট্ট্যাচার্য্য পরিবারের এক সদস্য মায়ের পোড়া মূর্তির সামনে ধ্যানে বসে জানতে পারেন পূজো হবে। তবে পুড়ে গিয়ে মুখ যেমন কালো শরীর,বাদামী রং হয়েছে ঠিক তেমন ভাবে মূর্তি গড়ে পুজো করা যাবে। সেই থেকেই প্রতিমার মুখ কালো এবং শরীর বাদামী রঙের হয়ে আসছে।

পুজোর শুরুতেই মহিষ বলির প্রচলন ছিল।কিন্তু মহিষ বলি দেওয়ার জন্য সেই সময় কেউ মায়ের প্রসাদ খেতেন না বলেই পরবর্তী কালে পাঁঠা বলি দেওয়া শুরু হয়। আবার পাঁঠা বলি দেওয়ার জন্য মা স্বপ্নাদেশ দিয়ে জানায় “শান্তির জন্য পুজো করে বলি?এটা বন্ধ করতে হবে।বন্ধ না হলে ভট্টাচার্য্য পরিবারের বংশ একেবারেই ধ্বংস করে দেবো।” এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর প্রায় ৬৪ বছর আগে পাঁঠা বলি দিতে গিয়ে,বলি দেওয়ার খড়গ্ আটকে যায়।ফলে সেই সময় বলি দেওয়া একপ্রকার ব্যাঘাত ঘটে।তারপর সেই থেকেই বলি দেওয়া প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য মায়ের আদেশ অনুযায়ী সপ্তমী,অষ্টমী ও সন্ধী পুজোয় চালকুমড়ো বলি এবং নবমীতে চালকুমড়ো,শশা,ও শত্রু বলি দেওয়ার প্রচলন শুরু হয় সেই থেকেই।

এই শত্রু বলি হল আতপ চালের মানুষের মূর্তি গড়ে মানকচু পাতার উপরে বলি দেওয়াকে শত্রু বলি বলা হয়।আরো জানা গেছে ৪৩৫ বছর একই পরিবার বংশ পরস্পরায় ঠাকুরের মূর্তি গড়ে চলেছেন।বর্তমানে সেই পাল বংশের বাংলাদেশ থেকে আসা সুন্দরবনের বাসন্তী থানা এলাকার পশ্চিম বাসন্তী গ্রামের বাসিন্দা গৌতম পাল মূর্তি গড়ার কাজ করেন।  আশ্চর্যের বিষয় ৪৩৫ বছর বয়সে একবারের জন্য কোনদিন ঠাকুরের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়নি বলে জানান ভট্টাচার্য্য পরিবারের সদস্যরা।এছাড়াও আরও একটি বিশষ বৈশিষ্ট রয়েছে যেখানে অন্যান্য মন্ডপে দেবী দুর্গার ডান দিকে লক্ষী গণেশ থাকে,সেখানে ভট্টাচার্য্য বাড়ীর প্রতিমার বাম দিকে গণেশ ও সরস্বতী রয়েছে।এছাড়াও যথারীতি নিয়ম নিষ্ঠা মেনেই দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন করে থাকেন।বিসর্জনের পর প্রতিমা জলের তলায় তিনদিন পুঁতে রাখা হয়,যাতে প্রতিমা গভীর জল থেকে উপর ভেসে না ওঠে।

এরপর সেই কাঠামো তোলা হয় লক্ষ্মী পুজোর পরের দিন।আবার আগামী বছরের জন্য প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয় জন্মাষ্টমীর পূণ্যতিথী থেকেই।

পুজোর সময় অষ্টমীর দিন সকল দর্শনার্থীদের পূজোর প্রসাদ বিতরণ করা হয়।পুজো করেন পরিবারের সদস্য প্রনব ব্যানার্জী।বর্তমান ভট্টাচার্য্য পরিবারে বর্তমানে আর্থিক অবস্থা সংকট হওয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সকলকে নিয়ে একটি ভট্টাচার্য্য পরিবারের ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে পুজো অনুষ্ঠিত হয়।

পুজো কটাদিন একান্নবর্তী ভট্টাচার্য্য পরিবারের অসীম,সঞ্জীব,মানস,রাজীব,চিরঞ্জীব,রুম্পা মৌসুমী,সুস্মিতা,সূপর্ণা ভট্টাচার্য্যরা পুজো কটাদিন এক সাথেই মেতে ওঠেন আনন্দে।