শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুন্দরবনে বাঘের আক্রমনে মৃত্যু হল মৎস্যজীবীর

News Sundarban.com :
আগস্ট ২০, ২০২১
news-image

বিশ্লেষণ মজুমদার, ক্যানিং – আবার বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হল এক মৎস্যজীবীর। মৃতের নাম অন্ন দাস(৩৫)। ঘটনাটি ঘটেছে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় প্রত্যন্ত সুন্দরবনের ঝিলা জঙ্গল সংলগ্ন চিলমারী খালে।স্থানীয় সুত্রে জানাগিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সন্দেশখালি থানার কানমারীর বাসিন্দা মৎস্যজীবী অন্ন দাস।তিনি আরো ৪ জন সঙ্গী কে নিয়ে বৃহষ্পতিবার বিকালে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন কাঁকড়া ধরার জন্য। এদিন সন্ধ্যা নাগাদ চিলমারী জঙ্গল সংলগ্ন কাঁকসা খালে তাদের নৌকা নোঙর করেন।সেখানেই জঙ্গল ঘেঁষা এলাকায় নৌকার উপর বসে কাঁকড়া ধরার দোন(সুদ) বাঁধছিলেন। সেই সময় সুন্দরবনের একটি বাঘ নৌকার উপরে বসে থাকা মৎস্যজীবীদের লক্ষ্য করে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসেছিল।

আপন মনে দোন বাঁধার সময় জঙ্গলের দিকে কোন নজর ছিল না মৎস্যজীবীদের।সুযোগ বুঝে আচমকা নৌকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ।অন্ন দাসের ঘাড় মটকে এক ঝটকায় টানতে টানতে সুন্দরবনের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সঙ্গী সাথীরা কাঁকড়া ধরা শিক আর নৌকার বৈঠা নিয়ে অন্ন দাস কে বাঘের কবল থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য লড়াই শুরু করে।

বাঘের রণমূর্তি আর হুঙ্কার কে অগ্রাহ্য করে দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে বাঘে মানুষে খন্ড যুদ্ধ চলে।অবশেষে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে বাঘ তার শিকার ছেড়ে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দেয়।সঙ্গী মৎস্যজীবীরা অন্ন দাস কে কোন ক্রমে উদ্ধার করে নৌকায় তোলে।দ্রুত নৌকার বৈঠা বেয়ে ওই মৎস্যজীবী কে স্থানীয় কুমীরমারীর ছোট মোল্ল্যাখালি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য।চিকিৎসকরা ওই মৎস্যজীবীকে মৃত বলে ঘোষনা করে।সুন্দরবন কোষ্টাল থানার পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করে শুক্রবার ময়না তদন্তে পাঠিয়েছে। পাশাপাশি কোষ্টাল থানার পুলিশ ও বন দফতর ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।অন্যদিকে ওই মৎস্যজীবীর পরিবার এমন দুঃসংবাদ পেয়ে শোকে ভেঙে পড়েছে।

উল্লেখ্য গত ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন গোসাবা জেমসপুরের বাসিন্দা রথীন সরকার। তাঁকে নৌকা থেকে বাঘে তুলে নিয়ে যায়।২৭ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় ছোট মোল্লাখালির বাসিন্দা নবীন সরকার। ২৯ এপ্রিল সুন্দরবনের ঝিলা ৫ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই মৃত্যু হয় গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চরঘেরীর বাসিন্দা সুজিত মন্ডলের।১৩ জুন কুলতলির দেউলবাড়ির গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ দুর্গাপুর গ্রামের চারজন মৎস্যজীবী সুন্দরবনের চিতুরি জঙ্গলের নদী খাঁড়িতে গিয়েছিলেন মাছকাঁকড়া ধরতে।

সেখানে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় গোষ্ঠ নাইয়ার। ১৯ জুলাই কুলতলি থানার প্রত্যন্ত গোপালগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫ নম্বর কৈখালি গ্রামের বাসিন্দা প্রফুল্ল সরদার সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যায়। ২৮ জুলাই কুমীরমারী গ্রামের ধরণী মন্ডলের মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।

২ আগষ্ট গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সুশান্ত মন্ডল ওরফে রাঙা(৫৬) মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।অন্যদিকে ১২ আগষ্ট গোসাবার বালি ২ গ্রামপঞ্চায়েতের বালি ৯ নম্বর গ্রামে বাসিন্দা হরিপদ মন্ডল(৪৫) সুন্দরবন জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।৪ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৪ জঙ্গলে প্রাণ হারায় মুন্না ওরফে রেজাউল গাজী,৬ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৬ জঙ্গলে সাতজেলিয়ার ঠাকুরুনতলা কলোনী পাড়ার গোপাল বৈদ্যের মৃত্যু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর কুমীরমারীর লেলিন কলোনির হরিপদ মন্ডল(৩২) নিখোঁজ হয়।

৩ অক্টোবর ছোট মোল্লাখালীর ৯ নং কালিদাসপুরের দীনবন্ধু জোদ্দার (৪৫) বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ১৩ অক্টোবর বালি বিরাজনগর বাদল বৈরাগী(৩২)সুন্দরবনের সূধন্যখালি জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়।

২০২১ সালে ২ জানুয়ারী গোসাবার লাহিড়ীপুর ১০ নং চরঘেরীর প্রশান্ত মন্ডল বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ৮ জানুয়ারী কুমীরমারীর বাসিন্দা শম্ভু গাঁয়েন (৬৭)মরিচঝাঁপির চিলমারী জঙ্গলে কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়।১৭ ফেব্রুয়ারী ঝড়খালি ৪ নম্বর এলাকার মৎস্যজীবি সৌমেন রায়(৩২) বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।১১ এপ্রিল কুমীরমারীর বাসিন্দা অমল বৈষ্ঞব(৪৭) ঝিলা জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে মারা য়ায়।

১ জুন গোসাবার লাহিড়ীপুরের চরঘেরীর বাসিন্দা ভগবতী মন্ডল(৩৮) সুন্দরবনের ঝিলা ৪ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের আক্রমণে মারা যায়। ৯ জুন কুমীরমারীর বুধবার বাজার সংলগ্ন মৃধা পাড়ার সুনীল মন্ডল(৩৫) মরিচঝাঁপি জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়।১৪ জুলাই গোসাবার লাহিড়ীপুরের চরঘেরীর ধরণী মন্ডল(৫৮)সুন্দরবনের ঝিলা জঙ্গলের কাঁকসা খালে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়।১৬ জুলাই গোসাবার সাতজেলিয়ার ২ নম্বর এমিলিবাড়ির বাসিন্দা দীনবন্ধু মন্ডল(৫১) ঝিলা ৫ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়ে প্রাণ হারায়।

সুন্দরবন এলাকায় ব্যাঘ্র বিধবাদের নিয়ে স্বনির্ভরতা করার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে চলেছেন বাসন্তী ব্লকের শিবগঞ্জ চম্পা মহিলা সোসাইটির কর্ণধার শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রাক্তন শিক্ষক তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী অমল নায়েক। তিনি জানিয়েছেন “সুন্দরবন জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে প্রতিনিয়ত মৃত্যু মিছিল বেড়েই চলেছে। স্বামী হারিয়ে বিধবা হচ্ছে অসংখ্য মায়েরা।তাছাড়া বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলোচ্ছ্বাসে সমগ্র সুন্দরবন জলমগ্ন। মানুষ যেমন সবকিছু হারিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে,তেমন জঙ্গলের বাঘ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত। অনাহারে দিন কাটছে। উভয়ই বাঁচতে চাইছে। সুন্দরবনে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য  সরকার অবিলম্বে বিকল্প আয়ের সংস্থা না করলে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু মিছিল কমবে না।”

অন্যদিকে বাঘের আক্রমণে মৎস্যজীবীর মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে শোক প্রকাশ করে সুন্দরবন মৎস্যজীবী রক্ষা কমিটির ক্যানিং মহকুমার সভাপতি শম্ভু সাহা  বলেন “ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক।সুন্দরবন জঙ্গলে প্রতিনিয়ত বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।দরিদ্র মৎস্যজীবীরা জীবন জীবীকার তাগিদে জীবন বিপন্ন করে সুন্দরবনের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে না যায় এবং বিকল্প রোজগারের সন্ধান পায় সে বিষয়ে রাজ্য সরকার মূখ্য ভূমিকা নিলে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল কমতে বাধ্য হবে। উদ্যোগ এবং অসচেতনতার অভাবেই সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।”