বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছেলের সামনে বাবা কে তুলে নিয়ে গেল ইয়াস বিধ্বস্ত সুন্দরবনের ক্ষুধার্ত বাঘ

News Sundarban.com :
জুন ৭, ২০২১
news-image

ভাষ্কর দাশ

ছেলের সামনে বাবা কে তুলে নিয়ে গেল ক্ষুধার্ত বাঘ। তবে বাঘের মুখ থেকে বাবা কে উদ্ধার করতে পারলে ও শেষ রক্ষা হল না।শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হল আনন্দ ধর (৫৭) নামে ওই মৎস্যজীবীর। ঘটনাটি ঘটেছে রবিবার প্রত্যন্ত সুন্দরবনের ঝিলা ২ নম্বর জঙ্গল লাগোয়া কাঁকসা খালে।

স্থানীয় সুত্রে জানা গিয়েছে গত ২৬ মে ইয়াসের তান্ডব আর জলোচ্ছ্বাসে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবন উপকুলবর্তী এলাকা।সেই সমস্ত এলাকার মানুষজন অসহায় হয়ে পড়েছে। সরকারী এবং বেসরকারী ত্রাণের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে ওই সমস্ত দুর্গত পরিবার গুলোকে। সংকটে পড়ে বাধ্য হয়ে পেট চালোনার তাগিদে সুন্দবরন জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরে অতিরিক্ত উপার্জনের দিকে ঝুঁকছে দুর্গত মৎস্যজীবী পরিবার গুলো।

রবিবার সকালে সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের মোল্লাখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট মোল্লাখালির ৯ নম্বর কালিদাসপুর গ্রামের মৎস্যজীবী আনন্দ ধর সুন্দরবনের নদীখাড়িতে কাঁকড়া ধরতে রওনা দিয়েছিলেন।সঙ্গী ছিলেন প্রতিবেশী এক মৎস্যজীবী শচীন মন্ডল ও নিজের একমাত্র ছেলে অমিত ধর।হাতে টানা নৌকা বেয়ে তারা পৌঁছে যায় সুন্দরবনের ঝিলা ২ নম্বর জঙ্গলের কাঁকসাখালে। সেখানে তারা নৌকা থেকে নেমে আপন মনে কাঁকড়া ধরার কাজ করছিলেন।

একসময় কাঁকড়া ধরার নেশায় আনন্দ বেশকিছুটা দূরে চলে যায় সঙ্গীদের থেকে।সেই সময় জঙ্গলের একটি ক্ষুধার্ত বাঘ আনন্দ’র উপর কঠোরভাবে নজর রাখছিল।নাগালের মধ্যে পেয়ে যেতেই সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ। আনন্দ’র ঘাড়ে থাবা বসিয়ে টানতে টানতে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।বাঁচাও বাঁচাও বলে কয়েকবার চিৎকার করে আনন্দ। চিৎকার শুনে মাথা তুলে তাকায় সঙ্গী দুই মৎস্যজীবী। কাঁকড়া ধরার শিক নিয়ে শুরু হয় বাঘে মানুষের মরনপণ লড়াই। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ মিনিট রুদ্ধঃশ্বাস লড়াইয়ের পর ক্ষুধার্ত বাঘ রেগতিক বুঝে রণে ভঙ্গ দেয়। শিকার ছেড়ে পালিয়ে যায় সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে।এরপর আক্রান্ত মৎস্যজীবী কে জীবন্ত অবস্থায় বাঘের মুখ থেকে বাঁচিয়ে কোন রকমে নৌকা তোলে। চিকিৎসার জন্য নৌকা বেয়ে তড়িঘড়ি গ্রামের উদ্দেশ্য পাড়িদেয়।গ্রামে পৌঁছানের আগেই অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণেই মৃত্যু হয় ওই মৎস্যজীবীর।বাবার মৃতদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ছেলে পৌঁছালে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

উল্লেখ্য গত ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন জেমসপুরের বাসিন্দা রথীন সরকার। তাঁকে নৌকা থেকে বাঘে তুলে নিয়ে যায়।

২৭ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় ছোট মোল্লাখালির বাসিন্দা নবীন সরকার। ২৯ এপ্রিল সুন্দরবনের ঝিলা ৫ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই মৃত্যু হয় গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চরঘেরীর বাসিন্দা সুজিত মন্ডলের।১৩ জুন কুলতলির দেউলবাড়ির গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ দুর্গাপুর গ্রামের চারজন মৎস্যজীবী সুন্দরবনের চিতুরি জঙ্গলের নদী খাঁড়িতে গিয়েছিলেন মাছকাঁকড়া ধরতে। সেখানে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় গোষ্ঠ নাইয়ার। ১৯ জুলাই কুলতলি থানার প্রত্যন্ত গোপালগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫ নম্বর কৈখালি গ্রামের বাসিন্দা প্রফুল্ল সরদার সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যায়।

২৮ জুলাই কুমীরমারী গ্রামের ধরণী মন্ডলের মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।২ আগষ্ট গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সুশান্ত মন্ডল ওরফে রাঙা(৫৬) মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।অন্যদিকে ১২ আগষ্ট গোসাবার বালি ২ গ্রামপঞ্চায়েতের বালি ৯ নম্বর গ্রামে বাসিন্দা হরিপদ মন্ডল(৪৫) সুন্দরবন জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।৪ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৪ জঙ্গলে প্রাণ হারায় মুন্না ওরফে রেজাউল গাজী,৬ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৬ জঙ্গলে সাতজেলিয়ার ঠাকুরুনতলা কলোনী পাড়ার গোপাল বৈদ্যের মৃত্যু হয়। ৩০সেপ্টেম্বর কুমীরমারীর লেলিন কলোনির হরিপদ মন্ডল(৩২) নিখোঁজ হয়।

৩ অক্টোবর ছোট মোল্লাখালীর ৯ নং কালিদাসপুরের দীনবন্ধু জোদ্দার (৪৫) বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ১৩ অক্টোবর বালি বিরাজনগর বাদল বৈরাগী(৩২)সুন্দরবনের সূধন্যখালি জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়।২০২১ সালে ২ জানুয়ারী গোসাবার লাহিড়ীপুর ১০ নম্বর চরঘেরীর বাসিন্দা মৎস্যজীবী প্রশান্ত মন্ডল বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ৮ জানুয়ারী কুমীরমারীর বাসিন্দা মরিচঝাঁপির চিলমারী জঙ্গলে কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়।১৭ ফেব্রুয়ারী ঝড়খালি ৪ নম্বর এলাকার মৎস্যজীবি সৌমেন রায়(৩২) বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।১জুন গোসাবার লাহিড়ীপুর পঞ্চায়েতের চরঘেরীর বাসিন্দ মৎস্যজীবী ভগবতী মন্ডল(৩৮) ঝিলা ৪ নম্বর জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।

সুন্দরবন এলাকায় ব্যাঘ্র বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে চলেছেন বাসন্তী ব্লকের শিবগঞ্জ চম্পা মহিলা সোসাইটির কর্ণধার তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী অমল নায়েক।

তিনি জানিয়েছেন  “সুন্দরবন জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে প্রতিনিয়ত মৃত্যু মিছিল বেড়েই চলেছে।স্বামী হারিয়ে বিধবা হচ্ছে অসংখ্য মায়েরা।তাছাড়া বর্তমানে জলোচ্ছ্বাসে সমগ্র সুন্দরবন জলমগ্ন। মানুষ যেমন সবকিছু হারিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে,তেমন জঙ্গলের বাঘ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত। অনাহারে দিন কাটছে। উভয়ই বাঁচতে চাইছে।সুন্দরবনে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য  সরকার অবিলম্বে বিকল্প আয়ের সংস্থা না করলে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু মিছিল কমবে না।”

অন্যদিকে বাঘের আক্রমণে মৎস্যজীবীর মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে শোক প্রকাশ করে সুন্দরবন মৎস্যজীবী রক্ষা কমিটির ক্যানিং মহকুমার সভাপতি শম্ভু সাহা  বলেন “ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক।

সুন্দরবন জঙ্গলে প্রতিনিয়ত বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।দরিদ্র মৎস্যজীবীরা জীবন জীবীকার তাগিদে জীবন বিপন্ন করে সুন্দরবনের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে না যায় এবং বিকল্প রোজগারের সন্ধান পায় সে বিষয়ে সরকার মূখ্য ভূমিকা নিলে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল কমতে বাধ্য হবে।”