মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাধারণ মানুষের মনোজগৎ বহু তাত্ত্বিকের চেয়ে ভালো বোঝেন মমতা

News Sundarban.com :
মে ৩, ২০২১
news-image

আলতাফ পারভেজ

মমতাকে নিয়ে বানানো বায়োপিক ‘বাঘিনী’ বিরোধী দলের আপত্তিতে কলকাতায় মুক্তি পায়নি এত দিন। কিন্তু বাংলার মেয়ে সিনেমার ‘বাঘিনী’র চেয়েও শক্তিশালী হয়ে মানুষকে জিতিয়ে নিল। গেরুয়া সুনামি বঙ্গে এসে থামল অবশেষে। কিন্তু এই ‘দিদি’র শক্তির জায়গাটা কোথায়?

রাজনীতিতে তিনি মূলত রসায়নবিদ

রাজনীতিতে মমতার বড় শক্তি সম্ভবত কোনো আদর্শ আঁকড়ে না থাকা। তিনি মূলত ক্ষমতার কাঙাল। ক্ষমতাই তাঁর কাছে মুখ্য ছিল এবং আছে। তিনি রাজনীতিকে নীতিশাস্ত্র হিসেবে না দেখে গণিত ও রসায়ন হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। যখন যাঁকে কাছে টেনে নেওয়া দরকার ভেবেছেন, নিয়েছেন। কেউ তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেও অবসন্ন হন না।

রাজ্যের ‘হাই ভোল্টেজ আসন’ নন্দীগ্রামে তাঁর এবারের প্রতিদ্বন্দ্বী শুভেন্দু অধিকারী একদা তৃণমূলেরই বড় সিপাহসালার ছিলেন। তাঁকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন মমতা। বহুদিন থেকে শুভেন্দু, ভাই সৌমেন্দু ও তাঁদের বাবা শিশির অধিকারী নন্দীগ্রামের রাজনীতিতে শেষ কথা। অধিকারী পরিবার এবার বিজেপিতে গেল, পশ্চিমবঙ্গে ছোটখাটো ভূকম্পনের মতো ছিল সেটা। মমতা ঘাবড়ে যাননি। ওই নন্দীগ্রামেই অধিকারীদের চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তাঁর ওই মারমুখী ভঙ্গিই দলকে জিতিয়েছে। তাঁর এই সাহস বাংলাভাষীরা পছন্দ করছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বরাবরই রাজনীতি করেছে ‘বহিরাগত’ ইস্যু নিয়ে। মুসলমানদের তারা এ রাজ্যে বাইরে থেকে আসা মানুষ প্রমাণ করতে চাইত। মমতার কৌশলবিদেরা সেই ‘বহিরাগত’ তির মুনশিয়ানার সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগানের মাধ্যমে। এ স্লোগান পরোক্ষে অমিত শাহ ও মোদিকে বাংলার রাজনীতিতে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষের আবেগের জায়গায় মমতাকে এগিয়ে দেয়।

তাঁর ধনেখালি শাড়িতে রক্তের দাগও আছে

ব্যক্তি মমতা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করেন। ‘খেলা হবে’ কিংবা ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ ইত্যাদি স্লোগান প্রমাণ করে মমতা সাধারণ মানুষের মনোজগৎ বহু তাত্ত্বিকের চেয়ে ভালো বোঝেন। রাজনীতিতে এই বোঝাপড়া তৈরি হয় মেঠো সংযোগ থেকে। ব্যক্তি মমতার প্রধান বৈশিষ্ট্য সেটাই। এ রকম সংযোগের নিয়মিত প্রাপ্তি হিসেবে কয়েকবার মার খেয়েছেন তিনি। ‘রহস্যময়’ দুর্ঘটনায় পড়েছেন। ১৯৯০-এর আগস্টে সিপিএম সমর্থকেরা দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে তাঁকে মাথায় মেরেছিল। এর তিন বছর পর তিনি আবারও পুলিশের হাতে বেদম পিটুনি খান। এভাবেই ক্রমে মমতার মারকুটে ইমেজ দাঁড়ায়। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে সেটা আরও পোক্ত হয়। কংগ্রেস ছাড়ার পরপর পশ্চিম মেদিনীপুরের ছোট আঙ্গারিয়ায় তাঁর গাড়িতে বোমা পড়ে। সেই ধারাবাহিকতাতেই এবার যখন তিনি নন্দীগ্রামে পায়ে চোট পেলেন, তার সত্যাসত্য নিয়ে বিরোধীরা যতই সন্দেহ ছড়াক, গণসহানুভূতি মমতার দিকেই গেছে।

স্বতন্ত্র দল হিসেবে যাত্রা করেই মমতা সফলতা পাননি। ২০০১ থেকে প্রথম পাঁচ বছর দলটির প্রাপ্তি ছিল সামান্য। কিন্তু হার মানতে এবং হাল ছাড়তে চাইছিলেন না মমতা। টিকে থাকতে বিজেপির সঙ্গেও জোট করেছিলেন। সেই ‘ভুল’ শোধরাতে হলো এবার সাধারণ ভোটারদের এগিয়ে এসে। পশ্চিমবঙ্গে মানুষ মমতাকে ‘পাশের বাড়ির চিরচেনা দিদি’ হিসেবেই নিয়েছে। এই নেওয়ার ভেতর পছন্দ-অপছন্দের হিস্যা হয়তো ৫১:৪৯। রাজনীতিবিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব দিয়ে এই সমীকরণের তরজমা করা মুশকিল। এর খানিকটা উত্তর মিলতে পারে মমতার সাদাসিধা চালচলনে, তাঁর বাঙালিয়ানায়। কিন্তু তাঁর ধনেখালি শাড়িতে কিছু রক্তের দাগও আছে। ক্ষমতার জন্য ‘শক্তি’র পূজা বাদ দেন না মমতা। তিনি প্রতিশোধপরায়ণও বটে। স্রেফ কার্টুন আঁকার দায়ে যাদবপুরের খ্যাতনামা অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে জেল খাটিয়েছেন। বামদের ‘দমবন্ধ করা নিপীড়ন’ থেকে তিনি মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গকে। অনেক স্থানীয় নির্বাচনে সিপিএমকে অংশ নিতে না দিয়ে সেই মুক্তিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর কর্মীরা।

তাঁর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার বাসনায় কংগ্রেস ছাড়তে মোটেই দ্বিধান্বিত হননি তিনি। কংগ্রেসে তিনি ‘অবাধ্য’ হয়ে উঠেছিলেন; আবার নিজের দলেও ভিন্নমতাবলম্বীদের সহ্য করা তাঁর ধাতে নেই। তিনি ‘ওয়ান ওম্যান আর্মি’র মতোই থাকতে পছন্দ করেন। তারপরও যে মানুষ তৃণমূলকে বেছে নিল, সেটা বড় ধাঁধা। নিচুতলার বাঙালির এলিটবিরোধী ঐতিহাসিক নীরব ঘৃণার সুবিধাভোগী মমতা। মমতা যে এলিট নন, এটাই তাঁর মূল ম্যানিফেস্টো হিসেবে দেখে শহর কলকাতার খেটে খাওয়া মানুষ আর দূর গ্রামের কৃষিসমাজ। হিন্দু-মুসলমান নিম্নবর্গের এই শ্রেণিযুদ্ধের পূর্বাপর বুঝতে কলকাতার তারকা কমিউনিস্টদের আরও কিছুদিন চলে যাবে।

সংখ্যালঘুরা এবারও তাঁর পাশে ছিল

তৃণমূলের আজকের সফলতাকে আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এমনও বলা যাবে না, ধারাবাহিকভাবে মমতা কেবল এগিয়েছেন। তবে শুরুটা ছিল দারুণ।

১৯৮৪ সালে সিপিএমের প্রভাবশালী নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে অভিষেক ছিল তাঁর। সোমনাথ চ্যাটার্জি লোকসভায় ১০ বার নির্বাচিত হওয়া নেতা। ১৯৭১ সাল থেকে তিনি লোকসভায় জিতে আসছিলেন। মাত্র একবারই হারেন। সেটা মমতার কাছে। তখনো মমতা ৩০ পেরোননি। পরের নির্বাচনে মমতা হেরে গিয়েছিলেন ওই যাদবপুরে। মাঝে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গড়েছেন। দলের প্রতীক হিসেবে নিলেন কাজী নজরুল ইসলামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক কবিতার সঙ্গে মিল রেখে জোড়া ঘাসফুল প্রতীক। দীর্ঘ উন্নয়নবঞ্চনায় ক্লান্ত মুসলমানরা সাড়া দিল তাঁর পরিবর্তনের ডাকে। ২০২১ সালেও তারা তাঁকে ছেড়ে যায়নি বলেই প্রমাণ মিলছে।

সম্বল মূলত মনের জোর

ভারতের ২৮টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র নারী মমতা। কিছুটা নারীত্বের শক্তিতেই রাজনৈতিক জীবনের সর্বশেষ কঠিনতম চ্যালেঞ্জে দলকে বাঁচালেন তিনি। মমতার আগেও ভারতে নারী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন উত্তর প্রদেশে মায়াবতী এবং তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা। মায়াবতীকে এগিয়ে দিয়েছিলেন কানশি রাম। জয়ললিতার জন্য ছিলেন রামচন্দ্রন। মমতা সেই তুলনায় একদম নিজের তৈরি। তাঁকে কেউ এগিয়ে দেয়নি। রাজনীতির কাজে লাগানোর মতো পারিবারিক বা অর্থের জোর তাঁর ছিল না। কেবল মনের জোর তাঁকে বিশাল ভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করে তুলল। বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে গিয়ে ভারতের সর্বত্র রাজনীতিবিদেরা নিরাপদ আসন খোঁজেন। মমতা নিরাপদ আসন ছেড়ে ঝুঁকিভরা নন্দীগ্রামে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বার্তাটি ভয়াবহ হুমকিতে ভরা ছিল, ‘আমি তোমাদের ক্যাম্পে এসেছি,Ñ পারলে ঠেকাও’। সেই চ্যালেঞ্জে তিনি বিক্ষত হয়েছেন, কিন্তু দল হারেনি।

সংঘ-পরিবার তাদের সামর্থ্যের সামান্যও বাকি রাখেনি এবার পশ্চিমবঙ্গ দখলের যুদ্ধে। তৃণমূল থেকে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠককে নিয়ে গেছে। মমতা তাঁর চিরাচরিত মনোবলের জোরে সেটা সামলে উঠেছেন। এই মানসিক দৃঢ়তা জাতীয় রাজনীতির মাঠেও তাঁকে অনেকখানি এগিয়ে দেবে।

বিজেপি ভেবেছিল সংগঠকদের বের করে এনে প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলকে দুর্বল করে ফেলতে পারবে। মমতা খেলার ছক পুরোই বদলে দিলেন—নির্বাচনকে ‘বিজেপি বনাম বাংলার মেয়ে’ গণভোটে পরিণত করে। সিপিএমকে ধরাশায়ী করার অভিজ্ঞতা থেকে মমতা ভালোই জানেন, ক্যাডারভিত্তিক দলকে মোকাবিলার সহজ রাস্তা পরিচয়বাদী সামাজিক উন্মাদনা। সিপিএমের লাখো কর্মী ২০১১ সালে মমতার জমির উন্মাদনার সামনে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অমিত শাহর এত দিনকার অজেয় গেরুয়া নির্বাচনী মেশিনও এবার স্রেফ ‘জয় বাংলা’র কাদামাটিতে আটকে গেল। নির্বাচনী ডামাডোলে বাংলার গত ১০ বছরের অন্যায়-অনাচার কিছুই সামনে এল না।

এবং অনিশ্চিত হলো তিস্তা চুক্তির ভাগ্য

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলে ভারতজুড়ে বিজেপির বিপরীতে ধুঁকতে থাকা আঞ্চলিক দলগুলো উদ্দীপনা খুঁজে নিতে পারে। আরএসএসের ধর্মবাদী রাজনীতিকে তৃণমূল যেভাবে ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে রুখল, সেটা দৃষ্টান্ত হিসেবে নতুন। আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজ নিজ পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে এভাবে মাঠে নামতে পারে আগামী দিনে। এমনকি মমতাকে সামনে রেখে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে নতুন জোটের আওয়াজও উঠতে পারে এখন। ধনেখালি শাড়ির জমিন সচরাচর ধূসর হয়। কিন্তু মমতা নিশ্চিতভাবে ভারতজুড়ে অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন এ মুহূর্তে। এই জয় কংগ্রেস নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকেও আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মমতাকে বাদ দিয়ে বামদের সঙ্গে কেন পশ্চিমবঙ্গ-কংগ্রেস নির্বাচনী আঁতাত করেছিল, তার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া তাদের জন্য এখন দুরূহ হয়ে গেল। বিজেপির জন্যও মুহূর্তটি বিব্রতকর। এই মমতাকে তারাই একদা জোটে নিয়ে মন্ত্রী করেছিল। মমতার এই বিজয় পশ্চিমবঙ্গে তাদের ঘোষিত নাগরিকত্ব আইনের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দিতে পারে। এনআরসি করাও কঠিন হবে এখন।

একই পরিণতি ঘটতে পারে তিস্তা চুক্তির ভাগ্যেও। ওড়াকান্দিতে মোদির সফর নিয়ে মমতা হয়তো মুখ খুলবেন এবার। কতটা তীব্র হবে সেই কথার বাণ, কেউ জানে না।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক