বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুন্দরবন জঙ্গলে বাঘের আক্রমনে নিখোঁজ মৎস্যজীবী

News Sundarban.com :
মার্চ ১৭, ২০২১
news-image

সুভাষ চন্দ্র দাশ,ক্যানিং- বুধবার সকালে বাঘের আক্রমনে নিখোঁজ হল এক মৎস্যজীবী।নিখোঁজ মৎস্যজীবীর নাম রীনা মণ্ডল(৪৭)।গোসাবা ব্লকের লাহিড়িপুর এলাকার বিধান কলোনির বাসিন্দা মৎস্যজীবি রীনা মন্ডল এদিন সকালে তার দেওর মহন্ত মন্ডল কে নিয়ে সুন্দরবনের কাঁকসা জঙ্গলের গাড়োল নদীতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন।সকালে আনমনে যখন নদী কাঁকড়া ধরছিলেন ,সেই সময় সকলের অলক্ষ্যে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল থেকে একটি বাঘ বেরিয়ে আসে। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে মৎস্যজীবী রীনার উপর । এক ঝটকায় ঘাড়ে তুলে নিয়ে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায় বাঘ।বৌদি কে চোখের সামনে থেকে বাঘে তুলে নিয়ে যাওয়ায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন মহন্ত।কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরতেই তিনি বাড়িতে রওনা দেয়।বাড়িতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনার কথা জানালে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।উল্লেখ্য গত চার বছর আগে রীনা দেবীর স্বামী ভবসিন্ধু মন্ডল জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারী সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে মৃত্যু হয় বাসন্তী ব্লকের ঝড়খালি ৪ নম্বর এলাকার বাসিন্দা মৎস্যজীবী সৌমেন রায়ের।গত ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন জেমসপুরের বাসিন্দা রথীন সরকার। তাঁকে নৌকা থেকে বাঘে তুলে নিয়ে যায়।২৭ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় ছোট মোল্লাখালির বাসিন্দা নবীন সরকার। ২৯ এপ্রিল সুন্দরবনের ঝিলা ৫ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই মৃত্যু হয় গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চরঘেরীর বাসিন্দা সুজিত মন্ডলের।১৩ জুন কুলতলির দেউলবাড়ির গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ দুর্গাপুর গ্রামের চারজন মৎস্যজীবী সুন্দরবনের চিতুরি জঙ্গলের নদী খাঁড়িতে গিয়েছিলেন মাছকাঁকড়া ধরতে। সেখানে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় গোষ্ঠ নাইয়ার। ১৯ জুলাই কুলতলি থানার প্রত্যন্ত গোপালগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫ নম্বর কৈখালি গ্রামের বাসিন্দা প্রফুল্ল সরদার সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যায়। ২৮ জুলাই কুমীরমারী গ্রামের ধরণী মন্ডলের মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।২ আগষ্ট গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সুশান্ত মন্ডল ওরফে রাঙা(৫৬) মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।অন্যদিকে ১২ আগষ্ট গোসাবার বালি ২ গ্রামপঞ্চায়েতের বালি ৯ নম্বর গ্রামে বাসিন্দা হরিপদ মন্ডল(৪৫) সুন্দরবন জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়।৪ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৪ জঙ্গলে প্রাণ হারায় মুন্না ওরফে রেজাউল গাজী,৬ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৬ জঙ্গলে সাতজেলিয়ার ঠাকুরুনতলা কলোনী পাড়ার গোপাল বৈদ্যের মৃত্যু হয়। ৩০সেপ্টেম্বর কুমীরমারীর লেলিন কলোনির হরিপদ মন্ডল(৩২) নিখোঁজ হয়। ৩ অক্টোবর ছোট মোল্লাখালীর ৯ নং কালিদাসপুরের দীনবন্ধু জোদ্দার (৪৫) বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ১৩ অক্টোবর বালি বিরাজনগর বাদল বৈরাগী(৩২)সুন্দরবনের সূধন্যখালি জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়। চলতি বছর ২ জানুয়ারী গোসাবার লাহিড়ীপুর ১০ নং চরঘেরীর প্রশান্ত মন্ডল বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ৮ জানুয়ারী কুমীরমারীর বাসিন্দা মরিচঝাঁপির চিলমারী জঙ্গলে কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়।

বনদফতর সুত্রে জানাগেছে মৎস্যজীবীদের বৈধ কোন অনুমতি পত্র ছিল কি না তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।তাছাড় যে সমস্ত জায়গায় মাছ কাঁকড়া ধরার উপর বনদফতরের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনুমান সেই নিষিদ্ধ জায়গাতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই বিপদ ঘটেছে।একাধিকবার বনদফতরের তরফ থেকে নিষিদ্ধ জায়গায় মাছ কাঁকড়া ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা মূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও এক শ্রেণীর মৎস্যজীবী সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সেই নিষিদ্ধ সুন্দরবনের জঙ্গল ও নদী খাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়ছেন। এই ঘটনাও তারই পুনরাবৃত্তি বলে দাবী বনদফতরের। সেই কারণে এ বিষয়ে মৎস্যজীবীদের আরও বেশী করে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বন আধিকারিকরা।
সুন্দরবন এলাকায় ব্যাঘ্র বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে চলেছেন বাসন্তী ব্লকের শিবগঞ্জ চম্পা মহিলা সোসাইটির কর্ণধার তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী শিক্ষক অমল নায়েক। এদিন মৃত মৎস্যজীবীর পরিবারের পাশে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে অমল বাবু জানিয়েছেন  “সুন্দরবন জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে প্রতিনিয়ত মৃত্যু মিছিল বেড়েই চলেছে।স্বামী হারিয়ে বিধবা হচ্ছে অসংখ্য মায়েরা।সুন্দরবনে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য  সরকার অবিলম্বে বিকল্প আয়ের সংস্থা না করলে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু মিছিল কমবে না।”
অন্যদিকে বাঘের আক্রমণে মৎস্যজীবীর মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে শোক প্রকাশ করে সুন্দরবন মৎস্যজীবী রক্ষা কমিটির ক্যানিং মহকুমার সভাপতি শম্ভু সাহা  বলেন “ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক।সুন্দরবন জঙ্গলে প্রতিনিয়ত বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।দরিদ্র মৎস্যজীবীরা জীবন জীবীকার তাগিদে জীবন বিপন্ন করে সুন্দরবনের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে না যায় এবং বিকল্প রোজগারের সন্ধান পায় সে বিষয়ে সরকার মূখ্য ভূমিকা নিলে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল কমতে বাধ্য হবে। উদ্যোগ এবং অসচেতনতার অভাবেই সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।”