ঢাকার দুর্গা পূজা : স্মৃতি-বিস্মৃতি

মতিন রায়হান , বাংলাদেশ:
ঢাকায় বাস করছি প্রায় তিন দশক হতে চললো। পূজার প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে চোখে ভাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পূজা মণ্ডপের কথা। মহা ধুমধাম করে সেখানে পূজার আয়োজন করা হতো। একটি মণ্ডপ ঘিরেই ছিল সে আয়োজন। নব্বইয়ের দশকের কথা বলছি। কিন্তু দেখতে দেখতে সে দৃশ্য আমূল বদলে গেল। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিভাগ জগন্নাথ হল মাঠে আলাদা আলাদা পূজার আয়োজন করে থাকে। এসব আয়োজনে ফুটিয়ে তোলা হয় প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব আইডেনটিটি। প্রতিমা থেকে শুরু করে মণ্ডপ সজ্জায় এর প্রতিফলন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এসব আয়োজন হয়ে থাকে বলে সাম্প্রতিক কালের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়আশয় মূর্ত হয়ে ওঠে মণ্ডপ সজ্জায়। কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের মণ্ডপ সজ্জার সঙ্গে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না বাংলা বিভাগের মণ্ডপ সজ্জার।
এই যে বৈচিত্র্য আর ভাবনাচিন্তার ফারাক, তা যেন পূজা মণ্ডপগুলোকে প্রকৃত অর্থেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছে। ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা কালি মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন মন্দির ইত্যাদি জায়গা দীর্ঘদিন ধরেই সবার কাছে সুপরিচিত। অধুনাকালে ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতেও বৃহৎ পরিসরে সর্বজনীন পূজার আয়োজন হয়ে থাকে। এসব আয়োজনের আভিজাত্য সহজেই সবার নজর কাড়ে। ধানমন্ডি এলাকার কলাবাগান মাঠের সর্বজনীন পূজা উৎসবও আজকাল জৌলুসময়। এছাড়া পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, ওয়ারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শিববাড়ি, সিদ্ধেশ্বরীসহ ঢাকার অন্যান্য এলাকার পূজা মণ্ডপও দুর্গোৎসবের ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দুর্গোৎসবের এই যে বহুবর্ণিল রং তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরজুড়ে।
ঢাক-ঢোলের বাদ্য, সানাইয়ের সুর আর খোল-করতালের ঝংকার এক অভূতপূর্ব দৃশ্যকাব্য রচনা করে। দল বেঁধে তরুণ-তরুণীরা বাহারি পোশাকে সজ্জিত হয়ে পূজা মণ্ডপগুলো ঘুরে বেড়ায়। নতুন পোশাক তো পূজার এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। অধুনাকালে ঢাকার ফ্যাশন হাউজগুলো পূজা উৎসবকে কেন্দ্র করে চমৎকার সব পোশাক ডিজাইন করে। সব বয়সির কথা মাথায় রেখেই ফ্যাশন হাউজগুলোর এই রংবাহারি আয়োজন। লাল পাড়ের সাদা শাড়ির সঙ্গে শাঁখা-সিঁদুর পরে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা দল বেঁধে পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন করেন তখন এক অন্যরকম দৃশ্যের অবতারণা হয়। শুধু কি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ? না, এই পূজা উৎসবের আনন্দে ভাগ বসান অন্য ধর্মের মানুষও। আর পূজা উৎসব প্রকৃত অর্থে তখনই হয়ে ওঠে সর্বজনীন। মানুষে-মানুষে গড়ে ওঠে সম্প্রীতির কাঙ্ক্ষিত সেতুবন্ধন।
এবারের এই মহামারি কাল যেন সর্বজনীন পূজা উৎসবে এক নিয়ন্ত্রণ রেখা টেনে দিয়েছে। একসঙ্গে পঁচিশ জনের বেশি মানুষের উপস্থিতি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। স্বভাবতই করোনা সংক্রমণের শঙ্কা মাথায় নিয়ে নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা করতে হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, অচিরেই এই দুঃসময় কেটে যাবে।
মানুষ আবারও নিশ্চিন্তে উৎসব-আনন্দে বুকে বুক মেলাবে। মানুষ জগতের বুদ্ধিদীপ্ত শ্রেষ্ঠ প্রাণী। আর এ কারণেই মানুষের জয় অনিবার্য। সবাইকে পূজার শুভেচ্ছা।