শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

থাবা মৎস্যজীবীর ঘাড়ে, বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ মৎস্যজীবী

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০
news-image

নিউজ সুন্দরবন ডেস্ক:  আবার বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হলেন এক মৎস্যজীবী। বুধবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রত্যন্ত গোসাবা ব্লকের সুন্দরবনের পাখিরালয় জঙ্গলের নদীখাঁড়ি এলাকায়।নিখোঁজ মৎস্যজীবীর নাম হরিপদ মন্ডল (৩২)। স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে গোসাবা ব্লকের সুন্দরবন কোষ্টাল থানার কুমীরমারির লেনিন কলোনী পাড়ার বাসিন্দা মৎস্যজীবী হরিপদ মন্ডল প্রতিদিনই সুন্দরবন জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে যেতেন এবং ফিরেও আসতেন।বুধবার সকালে প্রতিবেশী তিনজন মৎস্যজীবী কে সঙ্গে নিয়ে  একটি নৌকা করে মাছ,কাঁকড়া ধরার উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে পাড়িদেয়।এদিন সকালে পাখিরালয় জঙ্গল লাগোয়া নদীখাঁড়িতে এলাকায় তাদের নৌকা সুন্দরবন জঙ্গলের উপর তুলে রেখে সঙ্গীসাথীদের সাথে মাছ,কাঁকড়া ধরার কাজ করছিল হরিপদ।সকলের অলক্ষ্যে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল থেকে একটি বাঘ বেরিয়ে আসে। টার্গেট করে হরিপদ কে। নৌকার আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৎস্যজীবী হরিপদ মন্ডলের উপর।থাবা বসায় ঐ মৎস্যজীবীর ঘাড়ে।

এক ঝাঁটকায় কাঁধে তুলে নিয়ে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায় বাঘ।অন্যান্য সঙ্গী সাথী মৎস্যজীবীরা এই দৃশ্য দেখে কার্যত অবাক হয়ে যায়।তাঁরা গ্রামের বাড়িতে এসে মৎস্যজীবীর পরিবারের কাছে দুর্ঘটনার কথা জানায়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিখোঁজ মৎস্যজীবীর পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।এদিকে সুন্দরবনে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ আর এই দুইয়ের বিপদ যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবনে।আর জীবন জীবীকার তাগিদে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে সুন্দরবনের জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু এবং নিখোঁজের ঘটনা ঘটে চলেছে।বর্তমান সময়ের ঘটনার নজির করল বিগত কয়েক মাসে বাঘের আক্রমনে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।একাধিকবার বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ ও মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে সর্বত্র। বনদফতর সুত্রের খবর নিষিদ্ধ জায়গাতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই একাধিকবার বিপদ ঘটেছে। বনদফতরের তরফ থেকে নিষিদ্ধ জায়গায় মাছ কাঁকড়া ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা মূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও এক শ্রেণীর মৎস্যজীবী সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সেই নিষিদ্ধ সুন্দরবনের জঙ্গল ও নদী খাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়ছেন।যার ফলে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু মিছিল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

সুন্দরবন এলাকায় ব্যাঘ্র বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ সমাজসেবামূলক কাজ করে চলেছেন বাসন্তী ব্লকের শিবগঞ্জ চম্পা মহিলা সোসাইটির কর্ণধার তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী তথা শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত শিক্ষক অমল নায়েক। এদিন মৃত মৎস্যজীবীর পরিবারের পাশে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে অমল বাবু জানিয়েছেন  “সুন্দরবন জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে প্রতিনিয়ত মৃত্যু মিছিল বেড়ে চলেছে।স্বামী হারিয়ে বিধবা হচ্ছে অসংখ্য মায়েরা।সুন্দরবনে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য  সরকার অবিলম্বে বিকল্প আয়ের সংস্থা না করলে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু মিছিল কমবে না।সরকারের কাছে করজোড়ে বিনীত ভাবে আবেদন করে শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত শিক্ষক অমল বাবু আরো বলেন দয়া করে সুন্দরবন এবং সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের বাঁচান। আর তা না হলে আগামী দিনে এই মৃত্যু মিছিল নদীর ঢেউয়ের মতো বাড়তে থাকবে। সুন্দরবনের বুক থেকে বিলীন হয়ে যাবে দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবার গুলো।  ”

অন্যদিকে বাঘের আক্রমণে মৎস্যজীবীর মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে শোক প্রকাশ করে সুন্দরবন মৎস্যজীবী রক্ষা কমিটির ক্যানিং মহকুমার সভাপতি শম্ভু সাহা  বলেন “ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক।সুন্দরবন জঙ্গলে প্রতিনিয়ত বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।দরিদ্র মৎস্যজীবীরা জীবন জীবীকার তাগিদে জীবন বিপন্ন করে সুন্দরবনের নদীখাঁড়িতে মাছ কাঁকড়া ধরতে না যায় এবং বিকল্প রোজগারের সন্ধান পায় সে বিষয়ে সরকার মূখ্য ভূমিকা নিলে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল কমতে বাধ্য হবে।বিকল্প কোন প্রকার উদ্যোগ নেই এবং সচেতনতার অভাবেই সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।”

উল্লেখ্য গত  ২০ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন জেমসপুরের বাসিন্দা রথীন সরকার। তাঁকে নৌকা থেকে বাঘে তুলে নিয়ে যায়।২৭ এপ্রিল সুন্দরবন জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় ছোট মোল্লাখালির বাসিন্দা নবীন সরকার। ২৯ এপ্রিল সুন্দরবনের ঝিলা ৫ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়েই মৃত্যু হয় গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চরঘেরীর বাসিন্দা সুজিত মন্ডলের।১৩ জুন কুলতলির দেউলবাড়ির গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ দুর্গাপুর গ্রামের চারজন মৎস্যজীবী সুন্দরবনের চিতুরি জঙ্গলের নদী খাঁড়িতে গিয়েছিলেন মাছকাঁকড়া ধরতে। সেখানে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় গোষ্ঠ নাইয়ার। ১৯ জুলাই কুলতলি থানার প্রত্যন্ত গোপালগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫ নম্বর কৈখালি গ্রামের বাসিন্দা প্রফুল্ল সরদার সুন্দরবন জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যায়। ২৮ জুলাই কুমীরমারী গ্রামের ধরণী মন্ডলের মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।২ আগষ্ট গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সুশান্ত মন্ডল ওরফে রাঙা(৫৬) মৃত্যু হয় বাঘের আক্রমণে।

অন্যদিকে ১২ আগষ্ট গোসাবার বালি ২ গ্রামপঞ্চায়েতের বালি ৯ নম্বর গ্রামে বাসিন্দা হরিপদ মন্ডল(৪৫) সুন্দরবন জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ৩ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি জঙ্গল লাগোয়া চিলমারী খালে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে মৃত্যু হয় বাবুরাম রপ্তান(৩২),৪ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের ঝিলা ৪ নম্বর জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মুন্না ওরফে রেজাউল গাজীর(৩২)। ৬ সেপ্টেম্বর ঝিলা ৬ নম্বর জঙ্গলে মাছ,কাঁকড়া করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় গোসাবা ব্লকের সাতজেলিয়া অঞ্চলের ঠাকুরুনতলা কলোনী পাড়ার বাসিন্দা মৎস্যজীবী গোপাল বৈদ্য (৫৪)।