মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভূতের রাজা দিল বর

News Sundarban.com :
মে ২, ২০১৮
news-image

শ্রেয়শ্রী ব্যানার্জী

একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক। কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্পের জগতে খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। পাশ্চাত্য চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে বাঁধাধরা স্টুডিও-এর বাইরে রাস্তায় ছবির শুট্যিং প্রথম তিনিই শুরু করেন। তাঁর তৈরি ছবি দেখে আজও মুগ্ধ হয় ৮-৮০ সকলেই। তিনি আর কেউ নন, তিনি ভারতের সর্বকালের সেরা লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা,সংগীত পরিচালক, গ্রাফিক্স আর্টিস্ট সত্যজিৎ রায়।


২মে, ১৯২১ কলকাতায় জন্ম তাঁর। সাহিত্যিক পরিবারে জন্ম তাঁর, বাবা সুকুমার রায় ও ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায় দুজনেই লেখক। সাহিত্য তাঁর রক্তে রয়েছে। তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয় ভাষায় Ladri di biciclette, “বাইসাইকেল চোর”) দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।


নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে মাত্র ৮০ টাকা বেতনের বিনিময়ে “জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার” হিসেবে যোগ দেন। চিত্রসজ্জা বা ভিজুয়াল ডিজাইন সত্যজিতের পছন্দের একটি বিষয় ছিল ও সংস্থাটিতে তিনি ভালো সমাদরেই ছিলেন, কিন্তু সংস্থাটির ইংরেজ ও ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল (ইংরেজ কর্মচারীদেরকে অনেক বেশি বেতন দেয়া হত), আর সত্যজিতের মনে হত প্রতিষ্ঠানটির “ক্লায়েন্টরা ছিলেন মূলত বোকা। ১৯৪৩ সালের দিকে সত্যজিৎ ডি কে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা ‘সিগনেট প্রেস’-এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। ডি কে গুপ্ত তাঁকে সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা বইগুলোর প্রচ্ছদ আঁকার অনুরোধ করেন ও এ ব্যাপারে তাঁকে সম্পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতা দেন। এখানে সত্যজিৎ প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন, যার মধ্যে জিম করবেটের ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন ও জওহরলাল নেহেরুর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী বাংলা উপন্যাস পথের পাঁচালীর একটি শিশুতোষ সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু-র ওপরেও কাজ করেন।শান্তিনিকেতনে বিখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসু ও বিনোদ বিহারী মুখার্জির কাছে চিত্রকলা শেখেন তিনি। পরে তিনি বিনোদ বিহারী মুখার্জির উপরে তথ্যচিত্র বানান, ‘দি ইনার আই’ নামে। সেই শুরু, তারপর লন্ডনে ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জর্জ রেঁনোয়া-র সাথে দেখা করে এবং ইতালি পরিচালক ভিত্তোরিয়ো ডে-সিকার ছবি ‘বাইসেল থীভস’ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবি তৈরির ভাবনা আসে তাঁর। তাঁর সৃষ্টি ‘ফেলুদা’, ‘প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রগুলি বইমুখি করেছে তরুণ প্রজন্ম থেকে বৃদ্ধ সকলকে।তাঁর মতো অভাবনীয় প্রতিভা পাওয়া বিরল।১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালি’ ছবিটি পরিচালনার মাধ্যমে বিরাট সাফল্য পান তিনি। ছবিটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ১১টি পুরস্কার পায়। তারপর একাধিক জনপ্রিয় ছবি করেছেন তিনি, যা চিরকালীন সিনেমা প্রেমীদের হৃদয়ে থেকে যাবে। ‘অপু-ত্রয়ী’ অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ও ‘অপুর সংসার’ তাঁর অমর সৃষ্টি। ‘দেবী’, ‘তিন কন্যা’,’শাখা-প্রশাখা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ , ‘চারুলতা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘হিরক রাজার দেশে’, ‘সোনার-কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’,’মহানগর’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ প্রভৃতি, বিভিন্ন ঘরানার ছবি করেছেন তিনি। মহানায়ক উত্তম কুমার-কে নিয়ে ‘নায়ক’ ছবিটি করেছেন তিনি। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর পরিচালিত মোট ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছোটো-বড়ো মিলিয়ে মোট ৩৬টি ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি।
এসময় সত্যজিৎ একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন, যদিও তিনি অনুযোগ করতেন যে কলকাতার বাইরে তাঁর নিজেকে সৃষ্টিশীল মনে হত না। ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন, ফেদেরিকো ফেলিন্নির 8½ ছবিটি সেরা পুরস্কার জেতে। ষাটের দশকে জাপান সফরের সময় তাঁর অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। দেশে অবস্থানকালে কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে দার্জিলিং বা পুরি-তে চলে যেতেন ও সেখানে নির্জনে চিত্রনাট্য লিখতেন।
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সাইন্সেস তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেই ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন।জীবনের শেষ পুরস্কার একটি সম্মানসূচক অস্কার গ্রহণ করেন। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রয়াত পরিচালকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর।আজ ৯৭তম জন্মদিনে তাঁকে অশেষ শ্রদ্ধা। যতদিন ভারতীয় চলচ্চিত্র থাকবে তাঁর নাম ও অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থেকে যাবেন তিনি।