শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি গল্প

News Sundarban.com :
ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
news-image

‘দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর/ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর’… আজ তো কবিগুরুর সেই দিন। শুধুই ভালোবাসার। সারা বিশ্বের তাবৎ প্রেমিক-প্রেমিকাই—এ দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। ভালোবাসি কথাটা এই দিনে বলা যায় বারবারই!

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বিশ্বজুড়ে দিনটি ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ হিসেবে পরিচিত। একসময় দিনটি শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন এর ছোঁয়া ছড়িয়ে গেছে সবার মধ্যে। সব বয়সীদের জন্য ভালোবাসা প্রকাশের আজ এক বিশেষ দিন।

আজকের দিনে প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত ধরে হাঁটবেন অনেক দূর, চোখে চোখ রেখে জানাবেন হৃদয়ের কথা। আবার কেউ হয়তো ফুল হাতে সাহসী কিংবা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রিয়তমাকে জানাবেন নিজের অনুভূতির কথা। কেউ আবার মোবাইল ফোন কিংবা অনলাইন মেসেজে প্রিয়জনকে পাঠাবেন ভালোবাসার পংক্তিমালা। ফুল, বই, চকোলেট, কিংবা কার্ড দিয়ে প্রিয়জনকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছেন কেউ কেউ।

বসন্ত যেন উৎসবেরই একটা ঋতু। সাজ সাজ রবে বসন্তবরণের সঙ্গে সঙ্গে হাজির ভালোবাসা দিবসও। আজকের দিনে তরুণ-তরুণীর উচ্ছ্বাস দেখে কেউ হয়তো আড়ালে নিজের গোপন কিংবা হারানো ভালোবাসার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন! কিন্তু তাতে উৎসবের রঙ মলিন হবে না এতটুকুও। কারণ ভালোবাসা তো শুধু পাওয়ার নাম নয়, ভালোবাসাতেই আনন্দ!

‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি গল্প প্রচলিত। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, এক খ্রিস্টান যাজক ও চিকিৎসক সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে দিনটির নাম ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ রাখা হয়েছে। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি; খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে প্রাণদণ্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন ‘ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন’। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে ও তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইন’ম ডে’ হিসেবে পালন করা শুরু করেন। তবে ভিন্ন মতে, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন একজনকে ভালোবেসেছিলেন। আর চিঠিটি লিখেছিলেন তার কাছেই।

আরেক ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রতিবছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত ‘জুনো’ উৎসব। রোমান পুরানের বিয়ে ও সন্তানের দেবি জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এ দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তাদের নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয় তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ ও সেখান থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

আবার অন্য একটি ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দি করেন। কারণ তখন সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দি অবস্থায় তিনি একজন কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল। এরপর ৪৯৬ সালে পোপ সেইন্ট জেলাসিউও প্রথম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইনের স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ ঘোষণা করেন।

আমাদের দেশে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ উদযাপন শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। সারা বিশ্বের মতো বর্তমানে আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরাও ভালোবাসার বিশেষ এই দিনটি পালন করছেন তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে। ভালোবাসার উৎসবে মুখর আজ রাজধানী। উৎসবের এ ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম-বাংলার জনজীবনেও।

ভালোবাসার জন্য আলাদা কোনো দিবসের প্রয়োজন আছে কি? এমন প্রশ্ন বারবার উঠেছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ এর জবাবে বলেছিলেন, ‘ভালোবাসা একটি বিশেষ, সাত দিনের জন্য নয়। সারাবছর, সারাদিন ভালোবাসার। তবে আজকের এ দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষ।’ ভালোবাসা দিবসে উৎসবের মাতামাতি দেখে অনেকে দিনটির সমালোচনায়ও মেতে ওঠেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, থাক না ভালোবাসার জন্য বিশেষ একটি দিন। ক্ষতি তো নেই।

আসলেই ক্ষতি তো নেই। ‘ভালোবাসা’ হৃদয়ের এক এমন গভীর অনুভূতি যা কোনো ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না। এ নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে কত গান, কবিতা, সাহিত্য। ভালোবাসা যে শুধু আনন্দ দেয় তা নয়, মানুষকে কাঁদায়ও। কবির ভাষায় সে কথা ফিরে এসেছে বারবার। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়/সে কি কেবলি যাতনাময়।’ আবার ইংরেজ কবি শেলী বলেছেন, ‘বিষাদময় গানগুলোই আমাদের সবচেয়ে প্রিয়।’ শরৎচন্দ্রের ভাষায়, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ভালোবাসা এমন অনুভূতি যে কষ্ট পেলেও মানুষ বারবার ভালবাসতে চায়।’ ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেক্সপীয়রের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে—’ভালোবাসা সমুদ্রের মতো গভীর। যতই আমি তোমাকে ভালোবাসি ততই এর গভীরতা বাড়ে। ভালোবাসো কখনো শেষ হয় না।’

ভালোবাসা এমনই এক জাদুকরী শক্তি তা যতই দেওয়া যায় এর গভীরতা ততই বাড়ে। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, ভালোবাসার এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ুক পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা সব সম্পর্কের মধ্যে। জয় হোক ভালোবাসার।
-তাসলিমা তামান্না