শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অন্তত ৩৯টি সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা

News Sundarban.com :
সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
news-image

হাজারে হাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসছে প্রতিদিন। অথচ তাদের নাম-ধাম কেউ লিখে রাখছে না। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সূত্রই এবার আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কত, তা স্পষ্টভাবে জানাতে পারছে না। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অন্তত ৩৯টি সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। তাদের অনেকেই নতুন-পুরনো কোনো ক্যাম্পে না গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পথে পথে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে নতুন বসতি গড়ার চেষ্টা করছে শরণার্থী হয়ে আসা এই বিপন্ন মানুষগুলো।

রোববার টেকনাফের মৌচনিতে এমন একটি অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেলে ভিড় করে আসে অনেক নারী-পুরুষ। তাদের একজন মংডুর গড়াখালি থেকে আসা আবুল ফয়েজ বলেন, ‘আঁর নামম্মান ছাড়াংত তুল।’ তার কথার অর্থ দাঁড়ায়- ‘আমার নামটা লিস্ট করেন।’ শুধু ফয়েজ একা নন; নাম ‘ছাড়াংত’ করার দাবি ছিল সবারই। তারা বলছিলেন, কেউ তাদের নাম-ধাম লিখে রাখছে না। সেখানেই কথা হয় মংডুর ফয়েজিপাড়া থেকে আসা চলি্লশোর্ধ্ব নারী বদিউজ্জামালের সঙ্গে। রোসাঙ্গ রাজদরবারের কবি আলাওল লিখেছিলেন সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামালের আখ্যান। বহু পথ ঘুরে সয়ফুলমূলক যেখানে এসে সুন্দরী বদিউজ্জামালকে পেয়েছিলেন, সে জায়গার প্রাকৃতিক বিবরণ থেকে ধারণা করা যায়, এটাই আজকের রাখাইন প্রদেশ। আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়া বদিউজ্জামাল বিগতযৌবনা সন্তানহারা মা। রাখাইন থেকে উচ্ছেদ হয়ে আশ্রয়ের সন্ধান করছেন। মংডুর ফয়েজিপাড়া থেকে আসা বিধবা নারী বদিউজ্জামাল আগুনে পোড়া বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছেন তার ছেলে এনায়েতুল্লাহর লাশ। সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত সন্তানের লাশ দাফন না করেই পরিবারের অন্যদের নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। তাদের সামনে এখন কেবলই অনিশ্চিত জীবনের অন্ধকার।

বদিউজ্জামালের এমন ব্যতিক্রমধর্মী নামকরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি, অন্তত ১৬৫০ সাল থেকে রোহিঙ্গারা আছে রাখাইন প্রদেশে। আলাওল সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামালের আখ্যান রচনা
করেছিলেন ১৬৫০ সালের পর। কথাসাহিত্যিক তুষার কণা খোন্দকার বলেন, রোহিঙ্গারা অবশ্যই মিয়ানমারের নাগরিক। ফ্রান্সিস-বুকাননের জরিপেও তাদের উল্লেখ রয়েছে। ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন ১৭৯৯ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ভারতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের অধীনে চাকরি করার সময় ব্যাপক জরিপ পরিচালনা করেছিলেন। তার জরিপ রিপোর্টে রাখাইন অঞ্চলের ‘রুয়িঙ্গা’ ভাষাভাষী মানুষের খুব সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া যায়।

তুষার কণা খোন্দকার ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা অ্যাফেয়ার্স সেলে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন তিনি ছিলেন সহকারী সচিব। পরে স্বেচ্ছায় অবসরে গেলেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। তার মতে, রোহিঙ্গা বিষয়ক কার্যক্রমে সরকারের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। আমাদের দিক থেকে মিয়ানমারকে বোঝাতে হবে_ আমরা কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতাকে প্রশ্রয় দিই না। মিয়ানমারকে তাদের দ্বৈত নীতি পরিহারে বাধ্য করতে হবে। তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালে যে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল, তাদের আড়াই লাখকে ফিরিয়ে নিয়েছিল মিয়ানমার। পরে আবার ১৯৯২ সালে আসা দুই লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৭ জনের মধ্যে দুই লাখ ৩০ হাজার ফিরিয়ে নেয়।

এখন আবার ফিরিয়ে নেওয়া রোহিঙ্গাদেরই উচ্ছেদ করছে। এটা থামাতে হবে। তবে এটাকে আন্তর্জাতিকীকরণ বা আঞ্চলিকীকরণ করা যাবে না। এটা অবশ্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়েই সমাধান করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও মনে করেন, আন্তর্জাতিক সব সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশকে শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি সংবেদনশীল করে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তার মতে, মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছি। এখন আমরা যে শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছি; চেষ্টা করতে হবে মিয়ানমার যেন গণহত্যা থামাতে বাধ্য হয় এবং এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিরাপদে ও সসম্মানে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক কার্ড করার সরকারি পরিকল্পনাকে প্রশংসা করে বলেন, তবে তার আগে রোহিঙ্গারা যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে- সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তারা কত সংখ্যক এসেছে, তা-ও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে কম-বেশি ৩৪ হাজার নিবন্ধিত শরণার্থী ছাড়া বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে যত রোহিঙ্গা ঢুকেছে, তাদের কোনো হিসাব নেই। যখনই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করে, তখনই আগে থেকে বাংলাদেশে যারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত আছে, তারা নিজেরা নতুন আসা শরণার্থীদের একটা সংখ্যা নিরূপণের চেষ্টা করে। অন্তত গত বছরের অক্টোবরে এবং এবার আবার আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু হলে, এমনটাই দেখা গেছে।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আবদুল মতলব এবং ওই ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মোহম্মদ রশিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, এবার এ পর্যন্ত লাখ পাঁচেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারাও সংখ্যাটি নিরূপণ করেছেন অনুমানের ওপর নির্ভর করে। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এবার অন্তত ১৫০ গ্রামের সব রোহিঙ্গা চলে এসেছে এবং প্রতি গ্রাম থেকে গড়ে সাড়ে তিন হাজার মানুষ এসে থাকলে সংখ্যাটা হবে সোয়া পাঁচ লাখ।

এবার কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তা জানা নেই টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের। টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হোসেন সিদ্দিক গতকাল দুপুরে বলেন, ‘যে হারে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে, তাতে সংখ্যা গণনা করা খুবই মুশকিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, তাও আনুমানিক।’

টেকনাফ ও উখিয়া মিলে রোহিঙ্গাদের ছয়টি শরণার্থী শিবির রয়েছে। এগুলোর মধ্যে টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়ার দুটি এবং উখিয়ার কুতুপালং-এর দুটি পুরনো শিবির। এই চারটির মধ্যে আবার নয়াপাড়া এবং কুতুপালং-এর একটি নিবন্ধিত ও অন্য দুটি অনিবন্ধিত শরণার্থী শিবির। এ ছাড়া উখিয়ার বালুখালিতে গত বছর অক্টোবরে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করার পর নতুন করে একটি রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে উঠেছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে উখিয়ার ঠেংখালিতেও শরণার্থীদের নতুন বস্তি গড়ে উঠেছে। তবে এখন যেন টেকনাফের সর্বত্রই শরণার্থী শিবির। এই উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা দুই লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৯ জন। আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা যে তার চেয়ে বেশি- এটা সন্দেহাতীত। রোহিঙ্গারা অবশ্য অনেক দিন থেকেই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এবার আরও ছড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত জুন মাসে সমাপ্ত তাদের রোহিঙ্গা শুমারির মাধ্যমে জানতে পেরেছে, দেশের প্রায় ৫০টি জেলায় রোহিঙ্গারা রয়েছে। ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক শুমারি’ নামে পরিচালিত ওই শুমারির প্রকল্প পরিচালক ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপপরিচালক (শুমারি) আলমগীর হোসেন জানান, শুমারির আওতায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও পটুয়াখালী_ ছয় জেলায় থাকা রোহিঙ্গাদের গণনা করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ছবি তোলা এবং ডাটাবেজের কাজ করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপে আরও প্রায় ৫০ জেলায় তাদের আত্মীয়স্বজন আছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। শুমারিতে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা কত পাওয়া গেছে, তা জানতে চাইলে সদ্য সমাপ্ত ওই প্রকল্পের পরিচালক বলেন, ‘এটি ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প এবং প্রতিবেদন তাদের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছি। কিছু জানাতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই জানাবে।’

তবে  পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, শুমারিতে পাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা চার লাখ হবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসা মানুষের সংখ্যা ৭,০০,০০০ ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে গত ১৫ দিনে এসেছে প্রায় ৩,০০,০০০। শেখ হাসিনার সরকার নতুনদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, আর তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। কিন্তু মিয়ানমারের কারণে অগ্রগতি হয়নি, তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে এবং তা আরও জোরদার করা হয়েছে।’

এদিকে গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, জাতিসংঘ মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবেতর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। ওই আবেদনে জাতিসংঘ গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ বলে উল্লেখ করেছে।
রাজীব নূর ও আবদুর রহমান