শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বোনাস! বোনাস!!

News Sundarban.com :
আগস্ট ২৮, ২০১৭
news-image

অফিসে আসার সময় বউ পইপই করে বলে দিয়েছিল, ‘খুব সাবধানে আসবে কিন্তু! কোত্থাও দাঁড়াবে না, সোজা বাসায় আসবে!’

আপনারা যাঁরা ভাবছেন, আমার বউ আমাকে খুব ভালোবাসে বলেই এভাবে সাবধান করেছে, তাঁরা কিঞ্চিৎ ভুল করছেন। বউ আমাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিন এমন বিশেষ সাবধানবাণী দিয়ে আমার পথ প্রশস্ত করে দেয় না। আজ বিশেষ দিন, আজ আমাদের বোনাস দেবে। ঈদের বোনাস। প্রবাদ আছে, বাঙালি মাগনা পেলে আলকাতরা খায়। আমি অবশ্য বোনাস পেলে খাবি খাই। এত বছরের চাকরিতে এখন পর্যন্ত বোনাসের টাকা দিয়ে কীভাবে সব সামলে নেওয়া যায়, তা বুঝে উঠতে পারিনি। বউ বলে, ‘তোমার বুদ্ধি কম!’

আমি মেনে নিয়েছি। ফলে গতবার বোনাসের টাকা বউয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দেখা গেল বউয়েরও বুদ্ধি কম! বোনাসের টাকা দিয়ে সে-ও ঈদ ম্যানেজ করতে পারল না। ঈদের আগের রাতে আমরা দেখলাম, আমাদের অন্তত আরও ৩০ হাজার টাকা দরকার। এ ছাড়া ঈদ পার হবে না। যেহেতু আরও ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়, সেহেতু আমরা ঘরে বসে ঈদ পার করে দিলাম। ফেসবুকে আপ করলাম আগের ঈদের ছবি।

এবার তা হতে দেওয়া যাবে না। নগদ ১৫ হাজার টাকা পকেটে। বউয়ের কথামতো বাসে করে ফিরছি না, যদি পকেট কাটা যায়! রিকশা নিয়েছি। আকাশের দিকে মাঝেমধ্যে উদাস হয়ে তাকাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পকেটে টাকা থাকার কারণে সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছি না। একটা হাত পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। হাতে টাকার স্পর্শ পাচ্ছি, বেশ ভালো লাগছে! রিকশাও চলছে বেশ জোর গতিতে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, কী কী করব এই টাকা দিয়ে। আব্বার জন্য পাঞ্জাবি, আম্মার জন্য শাড়ি, ভাগনে-ভাতিজাদের জন্য জামাকাপড়, বউ তিন মাস থেকে জুস ব্লেন্ডার কিনতে চাচ্ছে, এবার ঈদে নাহয় তাকে ব্লেন্ডারই কিনে দিলাম। আর নিজের জন্য…নিজের জন্য যে-ই না ভাবতে গেলাম অমনি দেখলাম, রিকশা দাঁড়িয়ে পড়েছে। রিকশাওয়ালা ছুটে যাচ্ছে একটা নালার দিকে। প্রকৃতির ডাক কখন কীভাবে আসে তার তো ঠিক নেই! কিন্তু শুধু প্রকৃতির ডাক নয়, এর মধ্যে দেখি একটা ছাগলও ডেকে উঠল! পেছনে তাকিয়ে দেখি, হরিণরঙা একটা ছাগল তার মনিবের সঙ্গে রশিবাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। মনিবও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন! আমি অবশ্য ছাগলের ডাকে সাড়া দিলাম। তাকিয়ে থাকলাম ছাগলপানে। মনিব তার কর্ম শেষ করে আমাকে বলল, ‘কী, কুনুদিন ছাগল দেহেন নাই?’

আমি মনে মনে বললাম, ‘প্রতিদিন সকালে আয়না হয়তো দেখি না তো কী, সেলফি তো তুলি! ছাগল দেখব না?’

মুখে বললাম, ‘কিনলেন নাকি?’

: নাহ্! বেচতে গেছিলাম! হাটে কুনু দাম নাই!

: কত দাম?

: আপনে কিনবেন? হে হে! আপনি কিনতে পারবেন না! যান!

এই লোক বলে কী? আমি কিনতে পারব না? সে জানে না আমার কাছে কত টাকা আছে! আমার কাছে আছে পুরো ঈদের বোনাস! আমি তেড়ে বললাম, ‘আরে দাম বলেন না ক্যান? কত দাম?’

: ২৫ হাজার টেকা! কিনবেন?

মনটা দমে গেল। আমার কাছে এত টাকা নেই। আমার মনমরা মুখ দেখে ছাগলটারও সম্ভবত খারাপ লাগল। আসলে ভাইয়ের কষ্ট ভাই-ই তো বুঝবে। সে ব্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা করে কেঁদে উঠল। আমার বুকটাও মোচড় দিয়ে উঠল। আহারে!

মনিব অবশ্য আমার মুখ দেখে দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘কী, বলছিলাম না আপনে কিনতে পারবেন না! হুদাই!’

আমার রিকশাওয়ালা ততক্ষণে চলে এসেছে। সে দেখল তার প্যাসেঞ্জারকে অপমান করে যাচ্ছে একজন ছাগলবিক্রেতা। ব্যাপারটা বোধ হয় তার ভালো লাগল না। সে বলল, ‘ওই, এই ছাগলের দাম ২৫ হাজার হয় ক্যামনে?’

: তো কত হয়?

: ১০ হাজারের উপর একটা পয়সাও হইব না!

রিকশাওয়ালাকে দেখে আমিও একটু সাহস পেলাম। বললাম, ‘ঠিক! এই ছাগলের দাম ১০ হাজার টাকা!’

রিকশাওয়ালা আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘মাংস কিন্তু স্যার ভালো হইব! দেখেন না কেমুন হরিণের লাহান দেখতে!’

আমিও ফিসফিস করে বললাম, ‘আর ওজনও তো আছে!’

ছাগলবিক্রেতা আমাদের ফিসফিসানি দেখে বলল, ‘সলা কইরা লাভ নাই। এই ছাগল ১০ হাজার টেকায় দিমু না!’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘তো কত তে দিবা তুমি?’

: ২২ হাজারের নিচে এক পয়সাও না। নিলে টাকা দেন, ছাগল নেন।

রিকশাওয়ালা হইহই করে উঠল। বলল, ‘২২ হাজার টেকায় আগামী তিনটা ঈদেও এরে বিক্রি করতে পারবা না! মানুষের হাতে টেকা আছে নাকি যে তুমি এর দাম ২২ হাজার ধরতেছ!’

বলেই রিকশাওয়ালা ফিসফিস করে আমাকে বলল, ‘আপনার কাছে কত আছে?’

আমি বললাম, ‘আছে তো পনেরো। কিন্তুৃ।’

রিকশাওয়ালা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হইব না। এত ভালো খাসিটা এত কম দামে ছাড়ত না!’

ছাগলবিক্রেতা এবার ছাগলের রশি ধরে টান দিল। বলল, ‘চল যাই! এইগুলা খালি হুদাই ফাল পাড়ে!’

আমার মেজাজ খুব খারাপ হলো। বললাম, ‘১২ হাজার টাকায় দিবা? এর চাইতে দাম বেশি পাইবা না কিন্তু!’

: আপনারে বলছে! আমি এইটারে ২০ হাজার টেকায় সাতবার বিক্রি কইরা দেখামু!

রিকশাওয়ালা বলল, ‘ওই দিন আর নাই! এখন সব্বাই গরু কোরবানি দেয়, দেখো না? তোমার ছাগল কিনব কেডা?’

: না কিনলে নাই!

: তা-ও তুমি বিক্রি করবা না? না বিক্রি করলে ঈদ করবা কেমনে?

ছাগলবিক্রেতা একটু থমকাল। রিকশাওয়ালা এবার পেয়ে বসল। বলল, ‘এখনো সময় আছে, দিয়া দাও। ১৫ হাজার টেকা দিমুনে।’

ছাগলবিক্রেতা হঠাৎ করেই এগিয়ে এসে রশিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল, ‘যান, নিয়া যান!’ রিকশাওয়ালার সব কটা দাঁত বেরিয়ে গেল। বলল, ‘জিইত্যা গেছেন! ১৫ হাজার টেকায় ছাগল না সুন্দরবনের হরিণ পাইছেন! দেন, টেকাটা দিয়া দেন।’

আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করল। টাকা দিয়ে দেব মানে? এটা তো আমার বোনাসের টাকা। এই টাকা দিয়ে আমাদের কত কী করার প্ল্যান! ছাগলটা এরই মধ্যে ডেকে উঠল—ব্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা! ঠিক যেন আমিই ডাকছি!

শেষ খবর

প্রিয় পাঠক, একটি হরিণরঙা ছাগল ও একটি মানুষরূপী ছাগল এখন দাঁড়িয়ে আছি দরজার এপাশে। কলবেল চাপা হয়েছে। দরজা খুলবে আমার বউ। আমার বউ এই ছাগল দেখে নিশ্চয়ই খুশি হবে না। আপনারা দয়া করে আমার জন্য একটু দোয়া করবেন! আপনাদের এই বোনাস দোয়াটা এই মুহূর্তে আমার খুব দরকার!